পুঁজিবাজার থেকে গত ১৫ বছরে এক লাখ কোটি টাকা বা এক ট্রিলিয়ন টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এমন তথ্য উঠে এসেছে দেশের অর্থনীতি নিয়ে তৈরি করা শ্বেতপত্রে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাওয়া কোম্পানিগুলোর প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি, প্রতারণা এবং প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও জালিয়াতির মাধ্যমে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে উঠে আসা পুঁজিবাজারের এমন অবস্থাকে দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা লুণ্ঠন। শ্বেতপত্রে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো আগামীতে পুঁজিবাজারসহ সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়নে যেকোনো সিদ্ধান্তে দলিল হিসেবে থাকবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, শ্বেতপত্রে গত ১৫ বছরের পুঁজিবাজার নিয়ে যা বলা হয়েছে তা এক কথায় লুণ্ঠন। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন ব্যবসায়ীরা কীভাবে পুঁজিবাজারকে নষ্ট করেছে তা উঠে এসেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছেন।
আবু আহমেদ বলেন, এই শ্বেতপত্র নিয়ে অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে এটি যারা প্রস্তাব করেছেন তারা দেশের অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন এবং তারা দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জানেন। তাদের মাধ্যমে যে শ্বেতপত্রটি তৈরি করা হয়েছে সেটিকে দেশের সার্বিক অর্থনীতি দলিল হিসেবে উপস্থান করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দীর্ঘ সময় ধরেই বলে আসছি বুক বিল্ডিং বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে যেসব দুর্বল কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সেগুলোই বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। শ্বেতপত্রে সে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে মূলত আওয়ামী লীগের সময়কালটিকে বিবেচনা করা হয়েছে। সেখানে শুধু পুঁজিবাজার নয়, বড় বড় প্রকল্প, গ্যাস-বিদ্যুৎ খাত কোথায় লুণ্ঠন হয়েছে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময়ের আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হয়েই সবাই এই লুণ্ঠনে যুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যবসায়ী ছাড়া গত ১৫ বছরে কেউ ব্যবসা করতে পারেনি।
এমনকি দেশে সে সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে সেখানেও আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল বলে মনে করেন আবু আহমেদ।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, কারসাজিকারীরা আইন লঙ্ঘন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়ে টাকা লুপাট করেছে। পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুর্বল কোম্পানিকে ভালো কোম্পানি দেখিয়ে শেয়ারের মূল্য অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ারের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি।
আবু আহমেদ বলেন, শ্বেতপত্রে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, শ্বেতপত্রের সার্বিক বিষয়কে আরও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পুঁজিবাজারের বিষয়গুলো পুরোনো। শ্বেতপত্রটি আরও দেখে বিস্তারিত বলা যেতে পারে। এর বেশি বলতে চাচ্ছি না।
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, পুঁজিবাজারে প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। বাজারের মধ্যস্থতাকারী (ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক) দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক হয়েছে।
তবে পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, শ্বেতপত্রে যেসব বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে সেগুলোর আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। অর্থ পাচার, দুর্নীতি এগুলো গত ৫ আগস্টের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, মূলত সেই প্রতিবেদনগুলোকেই পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজার বিষয়ে যে বলা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে তার বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়নি। কারা কীভাবে এই টাকা আত্মসাৎ করেছে সেটি উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল।
স্বনামধন্য একটি সিকিউরিটিজ হাউসের শীর্ষ এই কর্তা ব্যক্তি বলেন, তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য প্রমাণ লাগবে। শ্বেতপত্রে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। ২০১০ সালে ইব্রাহিম খালেদ যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল সেটি নিয়েও বেশ হইচই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেখানে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের কি আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। শ্বেতপত্রের মাধ্যমে দুর্নীতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র।