চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহনকারী প্রায় ৭০০ লাইটারেজ জাহাজের শ্রমিকরা গত চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। আয় কমে যাওয়ার কারণে মালিকরা বেতন পরিশোধে সমস্যায় পড়েন।
তবে সিরিয়াল প্রথা পুনরায় চালু হওয়ায় শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে সমস্যা সমাধান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নতুন ভাড়া কাঠামো অনুযায়ী, লাইটারেজ জাহাজে পণ্য পরিবহনে খরচ কমানো হয়েছে, যা গত ৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।
জানা গেছে, বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বছরে প্রায় ৯ থেকে ১০ কোটি টন পণ্য পরিবহন হয়। এর মধ্যে ৭০ ভাগ পণ্য বাল্ক জাহাজ থেকে ছোট ছোট লাইটারেজ জাহাজে খালাস করে ৩৮টি নৌরুটে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। লাইটার জাহাজের ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার থেকে ২ হাজার টন পর্যন্ত। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৮০০ লাইটার জাহাজ পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে।
এ ছাড়া বাকি ৩০ ভাগ কনটেইনার পণ্য টাগবোটের সাহায্যে সরাসরি আনা হয় বন্দরের জেটিতে।
লাইটারেজ শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, বড় বড় শিল্পগ্রুপ ও বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন লাইটারেজ জাহাজ নৌপথে সারা দেশে পণ্য পরিবহন করে থাকে। এর মধ্যে শিল্পগ্রুপগুলোর অধীনে থাকা লাইটারেজ জাহাজের মালিকরা যথাসময়ে নাবিকদের বেতন পরিশোধ করে দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন ১ হাজার ১০০ লাইটারেজ জাহাজের মধ্যে অন্তত ৭০০ জাহাজের শ্রমিকরা গত চার মাস ধরে বেতন পাননি। অনেক শ্রমিক সাত মাস ধরে বেতন না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
শ্রমিক নেতারা হিসাব করে জানিয়েছেন, একটি লাইটারেজ জাহাজে গড়ে ১৩ জন নাবিক থাকেন। এর মধ্যে একজন মাস্টার, একজন ড্রাইভার, দুজন গ্রিজার, দুজন সুকানি, ছয়জন লস্কর ও একজন বাবুর্চি থাকেন। একজন মাস্টার ৪০ হাজার টাকা, একজন ড্রাইভার ৪০ হাজার টাকা, একজন গ্রিজার ১৮ হাজার টাকা, একজন সুকানি ১৮ হাজার টাকা, একজন লস্কর ১৬ হাজার টাকা ও একজন বাবুর্চি ১৬ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন।
আয় কমে যাওয়ায় গত চার মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেননি লাইটারেজ জাহাজ মালিকরা। বর্তমানে ৭০০ জাহাজে কর্মরত অন্তত ৯ হাজার ১০০ নাবিক কোনো বেতন পাননি। অর্থের হিসাবে, প্রতিটি জাহাজে মাস শেষে মালিকের বেতন বাবদ ব্যয় হয় প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ৭০০ জাহাজে কর্মরত শ্রমিকরা গত চার মাসে বেতন বাবদ প্রায় ৭৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা পান মালিকদের কাছে।
তবে লাইটারেজ জাহাজ মালিকরা বলছেন, লাইটারেজ জাহাজে করে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল, গম, সার, সিমেন্ট ক্লিংকার, পাথর, চিনি, সার, খাদ্যপণ্য, স্ক্র্যাপ, কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হয়। এতদিন সিরিয়াল প্রথা না থাকা, নির্দিষ্ট ভাড়ার কাঠামো না থাকায় এ খাতে একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আয় কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। সামনে যথাসময়ে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন লাইটারেজ জাহাজ মালিকরা।
বাংলাদেশ লাইটার শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি মোহাম্মদ নবী আলম বলেন, ‘চার মাস নয়, কোনো কোনো জাহাজের শ্রমিক সাত মাস বেতন পাননি, এমন রেকর্ড রয়েছে। এতদিন ঠিকমতো আয় না আসায় মালিকরা বেতন দিতে পারেননি। মালিকপক্ষের আয় বৃদ্ধি ও শ্রমিকদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াল প্রথা পুনরায় চালু করার বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়ে আসছিলাম। আমাদের সবার প্রচেষ্টায় এখন সিরিয়াল প্রথা আবার চালু হয়েছে, ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর থেকে তা বাস্তবায়ন হয়েছে।
আমরা সার্বিক বিষয় আগামী এক মাস পর্যবেক্ষণ করব। আমরা আশাবাদী, মালিকরা সামনে যথাসময়ে শ্রমকিদের বেতন দিতে পারবেন। এরপরও যদি সমস্যাটি থেকে যায় তখন পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’
লাইটারেজ জাহাজ কাদিরিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজী শফি বলেন, ‘আয় ঠিকমতো না আসায় গত ছয় মাস ধরে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। লোকসানে পড়ে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছেন। এ খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান হয়েছে। আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।’
বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভোয়া) কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সংস্থাটি পরিচালনার জন্য ২০১৪ সালের ২১ মে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ডব্লিউটিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে অভ্যন্তরীণ নৌরুটে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য পরিবহন করা হতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায় সিরিয়াল প্রথা। ফলে অভ্যন্তরীণ নৌরুটে জাহাজ চলাচলে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। এদিকে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হওয়ায় জাহাজ ভাড়া তুলনামূলকভাবে অনেক কমে যায়। শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন জাহাজ মালিকরা।
বিষয়টি সমাধানে পুনরায় সিরিয়াল পদ্ধতিতে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক)।
এ নিয়ে এই তিন সংগঠনের মধ্যে গত ১ নভেম্বর নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় একটি হোটেলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একই সঙ্গে আগের তুলনায় ভাড়া কমিয়ে নতুন করে নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
বিডব্লিউসিসি জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ গন্তব্যে আগে ক্লিংকার পরিবহনে টনপ্রতি ভাড়া নেওয়া হতো ৫৭৪ টাকা, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৫০ টাকা। জিপসামে ৬০৬ টাকার ভাড়া এখন ৫৬৮ টাকা, বল ক্লের ভাড়া ৫৮৩ টাকার স্থলে ৫৫০ টাকা, টিএসপি বা ড্যাপের ভাড়া ৬৪১ টাকার স্থলে ৫৯৪ টাকা, লবণে ৭৪৯ টাকার ভাড়া ৬৭৫ টাকা, কয়লা ও চিনির (ব্যাগ) ভাড়া ৬৬৬ টাকার স্থলে ৬১২ টাকা, গমের ভাড়া ৬৬২ টাকার স্থলে ৬১০ টাকা, পাথরের (১০ মিমি) ভাড়া ৬২৫ টাকার স্থলে ৫৮১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শুধু ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ নয়, নতুন তালিকায় মেঘনা, মুক্তারপুর, কাচপুর, আলীগঞ্জ, নিতাইগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনা, মোংলা, নগরবাড়ী, টেপাখোলা, বাঘাবাড়ী, আশুগঞ্জ, ভৈরব, দাউদকান্দি, ঘোড়াশাল, পলাশ, রূপসী, সন্দ্বীপ, ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বসিলা, ছাতক, সুনামগঞ্জ, মোল্লারহাট, শরীয়তপুর, মাওয়া, ইটনা, বাবুগঞ্জ, বরগুনা, লালমোহন, পায়রা, আরিচা, মীরসরাই ইকোনমিক জোন, কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, বাহারছড়া, গন্ডামারা, শিকলবাহা ও কালুরঘাট সেতুসহ বিভিন্ন গন্তব্যের ভাড়া কমানো হয়েছে। গত ৪ নভেম্বর থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হয়েছে।