চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ঘাটতির চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ঘাটতির কারণ ও এ থেকে বেরিয়ে আসতে এনবিআর কী করছে তা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। একই সঙ্গে আদায় বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফের প্রতিনিধিরা।
এনবিআর জানিয়েছে, রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করতে প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগিরই এর সুফল পাওয়া যাবে। রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বাড়বে। ফলে অর্থবছরের শেষ হিসাবে ঘাটতি থাকবে না। বরং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হবে। এনবিআর সূত্রে এসব জানা গেছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে তার দপ্তরে আইএমএফের প্রতিনিধিদল বৈঠকে বসে। এ সময় এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের তিন শাখা- আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শুরু হয় বেলা আড়াইটায়, শেষ হয় ৪টা ১৫ মিনিটে।
সূত্র জানায়, এনবিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান নিয়ে বৈঠকের শুরুতেই আলোচনা হয়। পরিসংখ্যানে উল্লেখ আছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর- এই চার মাসে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় কমেছে ৩০ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসের চেয়েও চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ১ দশমিক ৩ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৫ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি এনবিআর।
জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। জুলাইয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। পরের মাস আগস্টে ৩১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আদায় কমেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৯ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৯ হাজার ২ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অক্টোবর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৫ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা। আদায় কমেছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বৈঠকে উপস্থিত আইএমএফের প্রতিনিধিরা বলেন, ঘাটতির চক্র থেকে বের হয়ে না এলে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে না। সরকার বড় ধরনের অর্থসংকটে পড়বেও বলে আইএমএফের প্রতিনিধিরা সতর্ক করেন।
ভবিষ্যতে ঘাটতিতে পড়বে না বলে জোর দিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, করদাতা বাড়ানোর পাশাপাশি রিটার্ন জমা বাড়াতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে রিটার্ন জমার সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। রাজস্ব খাতের সংস্কার কার্যক্রম ও মিথ্যা ঘোষণা বন্ধে কঠোরতার কথা জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরসহ প্রতিটা শুল্ক স্টেশনে মিথ্যা ঘোষণা বন্ধে জোর দেওয়া হয়েছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে ইএফডির পাশাপাশি অন্য আরও আধুনিক পদ্ধতি চালুর করার বিষয় নিয়েও প্রস্তুতি চলছে। সারা দেশের ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে কাজ চলছে। এমন পদ্ধতিতে যাওয়া হচ্ছে যে, কোনো প্রতিষ্ঠান ভ্যাট না দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে না।
সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনীতির শ্বেতপত্রের কথা তুলে ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অপ্রয়োজনে দেওয়া সব ধরনের রাজস্ব অব্যাহতি প্রত্যাহার করতে কাজ চলছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর যে যার অবস্থান থেকে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। কর ফাঁকি উদ্ঘাটন হলে ২৫ হাজার টাকার বেশি এনবিআরের কোষাগারে আসবে, যা চলতি অর্থবছরের শেষ হিসাবে যোগ হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এনবিআরের কাজে গতি বাড়ানো হয়েছে। ব্যাপক সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি, এতে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি এড়ানো সম্ভব হবে।’
প্রসঙ্গত, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে এমন শর্ত মেনেই আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ। এ শর্ত পূরণ না হলে ঋণের কিস্তি ছাড় করা হবে না বলেও ঋণ অনুমোদনের আগেই জানিয়েছিল সংস্থাটি। অথচ ঋণ পাওয়ার পর থেকে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে এনবিআর। আইএমএফ ও এনবিআরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আগের বৈঠকগুলোর মতোই গতকালের বৈঠকেও ঋণ পাওয়ার শর্ত উল্লেখ করে আইএমএফের প্রতিনিধিরা জানান, আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ৯ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করতে হবে।