আগামী বছর থেকে একটি ‘যথার্থ শিথিল’ মুদ্রানীতি গ্রহণ করবে চীন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে আরও সক্রিয় আর্থিক নীতি গ্রহণ করবে দেশটি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বোচ্চ রাজনৈতিক অঙ্গ পলিটব্যুরো এমনটা জানিয়েছে। খবর রয়টার্সের।
পলিটব্যুরোর শীর্ষ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তাদের একটি বৈঠকের প্রতিবেদন উল্লেখ করে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম সিনহুয়া জানিয়েছে, দেশটি নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ভোক্তা ব্যয় বাড়ানোর ওপর জোর দেবে। এই বক্তব্যগুলো এমন পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে যখন আসন্ন বার্ষিক সেন্ট্রাল ইকোনমিক ওয়ার্ক কনফারেন্সের প্রস্তুতি চলছে। এই সম্মেলনে আগামী বছরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণ করা হবে।
খবরে বলা হয়, পলিটব্যুরোর বৈঠকের বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর শেয়ারবাজারে উল্লম্ফন ঘটেছে এবং বেড়েছে চীনের সরকারি বন্ডের দামও। হংকংভিত্তিক হ্যাং সেং সূচক ২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে এক মাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে।
সিনহুয়া জানিয়েছে, ২০২৫ সালে চীনা কর্তৃপক্ষকে ‘স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অগ্রগতির নীতিতে অটল থাকতে হবে’।
বিবৃতিতে বলা হয়, আরও সক্রিয় আর্থিক নীতি ও যথার্থ শিথিল মুদ্রানীতি প্রয়োগ করা উচিত। সেই সঙ্গে নীতির অন্য বিষয়গুলোর উন্নয়ন ও পরিমার্জন করা এবং অসাধারণ প্রতিঘাতচক্র সংশোধনী পদক্ষেপগুলোকে শক্তিশালী করা উচিত।
পলিটব্যুরো আরও জানিয়েছে, আবাসন বাজার ও শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে হবে। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু তারা উল্লেখ করেনি।
শিথিল মুদ্রানীতি
পলিটব্যুরো বৈঠকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাগুলোর ভিত্তিতে মুদ্রানীতির এই নতুন ভাষ্য ২০১০ সালের শেষ দিক থেকে প্রথমবারের মতো অবস্থান শিথিলের নির্দেশ দেয়। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক পরিষেবা সংস্থা এএনজেডের চীনবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কৌশলবিদ শিং ঝাওপেং বলেন, ‘আমরা মনে করি এটি শক্তিশালী আর্থিক প্রণোদনা, বড় (সুদের) হার কমানো এবং ২০২৫ সালে সম্পত্তি কেনার দিকে ইঙ্গিত দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘নীতির ভাষ্য, ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির বিরুদ্ধে শক্তিশালী আস্থার প্রতিফলন ঘটায়।’
রয়টার্স জানায়, চলতি বছর চীনের অর্থনীতি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে, যার ফলে নীতিনির্ধারকদের সেপ্টেম্বর মাসে পদক্ষেপ নিতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মহামারির পর থেকে সবচেয়ে আগ্রাসীভাবে মুদ্রানীতি শিথিলকরণের পদক্ষেপ নেয়, যার মধ্যে সুদের হার কমানো ও আর্থিক ব্যবস্থায় ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সরবরাহ করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চীন হয়তো এ বছর প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ২০২৫ সালে সেই গতি বজায় রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে আসছেন এবং চীনা আমদানির ওপর ৬০ শতাংশ বা তার বেশি শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন তিনি।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচ ধরনের নীতির অবস্থান নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো ‘শিথিল’, ‘যথার্থভাবে শিথিল’, ‘সতর্ক’, ‘যথার্থভাবে কঠোর’ ও ‘কঠোর’। এগুলোর প্রতিটি নীতির ক্ষেত্রেই আবার উভয় দিকেই নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি অনুযায়ী এই নীতিগুলোকে সামান্য পরিবর্তন করতে পারে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর চীন ‘যথার্থভাবে শিথিল’ মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। তবে ২০১০ সালের শেষ দিকে ‘সতর্ক’ অবস্থানে ফিরে আসে।
এদিকে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে চীন ১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১ দশমিক ৪০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করে, যার লক্ষ্য স্থানীয় সরকারগুলোর অর্থায়ন সংকট কমানো এবং দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল করা। তবে এই ঋণ ব্যবস্থাগুলোর উদ্দেশ্য মূলত দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে পৌরসভার আর্থিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা, সরাসরি অর্থনীতিতে অর্থ ঢালা নয়।
চলতি বছর চীনের অর্থনীতিতে উৎপাদন ও রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেখা গেছে। কারণ, আবাসন খাতের চাহিদা আশানুরূপ নয়। সম্পত্তি বাজারের গুরুতর সংকট ভোক্তাদের সম্পদকে লোকসানের মুখে ফেলেছে এবং বেশির ভাগ সরকারি প্রণোদনা যাচ্ছে উৎপাদক ও অবকাঠামো খাতে।
সরকারি উপদেষ্টারা বেইজিংকে আগামী বছরের জন্য প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অপরিবর্তিত রাখার সুপারিশ করছেন। তবে তারা আরও বেশি পরিমাণে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রত্যাশিত মার্কিন শুল্কের প্রভাব কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি হ্রাসজনিত চাপ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করবে। খবরে বলা হয়, ট্রাম্পের শুল্ক হুমকি চীনের শিল্প খাতকে নাড়া দিয়েছে, যা প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে। চীনের অর্থমন্ত্রী লান ফোয়ান জানিয়েছেন, আরও উদ্দীপনা ব্যবস্থা আসছে, তবে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করেননি।
অর্থনীতিবিদরা বেইজিংকে ভোক্তাকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং নিম্ন-আয়ের বাসিন্দাদের জন্য আরও বেশি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া তারা কর, কল্যাণ ও অন্য নীতিগত পরিবর্তনগুলো দ্রুত কার্যকর করার পরামর্শ দিয়েছেন, যা কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়ক হবে।
তবে এখন পর্যন্ত চীনা কর্তৃপক্ষ মূলত রপ্তানি নির্ভর উৎপাদন খাতকে আধুনিকায়নের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। এতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে বৈদ্যুতিক যানবাহন, সৌরশক্তি ও ব্যাটারি খাতে, যার ফলে মূল বাণিজ্যিক অংশীদাররা প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছে।