
ভোজ্য তেল, এলাচ, পেঁয়াজের পর এবার আলু নিয়ে কারসাজিতে মেতে উঠেছে অসাধু চক্র। কৃষক পর্যায়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি হওয়া আলু ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে আলুর দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা।
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম চড়া হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাহাড়তলীর আলুর এক আড়তদার বলেন, মুন্সীগঞ্জের কোল্ড স্টোরেজগুলোতে প্রচুর আলু মজুত করে রাখা হয়েছে। অল্প অল্প করে চাহিদা বুঝে আলু বাজারে ছাড়া হচ্ছে। আলু কত দামে বিক্রি হবে সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সেখান থেকেই। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আগে মুন্সীগঞ্জের সিন্ডিকেটটি ভাঙতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জে কৃষক পর্যায়ে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) আলু বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭৫০ টাকায় (কেজিপ্রতি দাম পড়ে ৩৫ টাকা)। এক সপ্তাহ আগে হিমাগারে প্রতি বস্তা আলু বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ২০০ টাকায়। বর্তমানে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায় (কেজিপ্রতি দাম পড়ছে ৫৪ টাকা)।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও পাহাড়তলীর আড়তে এই আলু কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫৯ টাকায়। তবে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়।
চট্টগ্রামের আড়তদাররা মুন্সীগঞ্জ ও জয়পুরহাট থেকে আলু সংগ্রহ করেন। বর্তমানে বৃহৎ এই তিন বাজারে রাজত্ব করছে মুন্সীগঞ্জের আলু। এই আলু কিনে আনলেও কোনো আড়তদারের কাছে রসিদ নেই। চট্টগ্রামে আলু কত দরে বিক্রি হবে সেটা মুন্সীগঞ্জ থেকেই মুঠোফোনে নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, আলুর বাজার চড়া হওয়ার পেছনে চট্টগ্রামের অন্তত ১৭ জন আড়তদার ও মুন্সীগঞ্জের ৫০ জনের অধিক হিমাগার মালিক জড়িত। তারা পরস্পর যোগসাজশে দিনকে দিন আলুর বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছেন।
সূত্র জানায়, মুন্সীগঞ্জে হিমাগারে আলু মজুত রেখে দাম বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে নিপ্পন কোল্ড স্টোরেজ, বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজ, কদম রসুল কোল্ড স্টোরেজ, এলাইড কোল্ড স্টোরেজ, দেওয়ান আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ, টংগীবাড়ী আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ, আলি কোল্ড স্টোরেজ, কোহিনুর কোল্ড স্টোরেজ, নুরানি হিমাগার, পপুলার কোল্ড স্টোরেজ, সানফ্লাওয়ার স্টোরেজ, একতা কোল্ড স্টোরেজ, সোবহান কোল্ড স্টোরেজ, কমবাইন্ড কোল্ড স্টোরেজ, সিলিপপুর কোল্ড স্টোরেজসহ অন্তত ৫০টির বেশি হিমাগারে আলু মজুত করা হয়েছে।
এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন চট্টগ্রামের আলুর বড় আড়তদার মেসার্স লাকী স্টোর, ফেনী বাণিজ্যালয়, কুমিল্লা ট্রেডার্স, আব্দুল বারেক ট্রেডার্স, মোহরা বাণিজ্যালয়, এসএম ট্রেডার্স, রউফ বাণিজ্যালয়, মক্কা বাণিজ্যালয়, মামুন ট্রেডার্স, মা বিতান, কুসুমপুরা বাণিজ্যালয়, জননী ট্রেডার্স, দাউদকান্দি বাণিজ্যালয়, রাজমহল বাণিজ্যালয়, কুসুমপুরা ট্রেডার্স, ইউসুফ ট্রেডার্স ও শাহ আমানত ট্রেডার্স।
রিয়াজুদ্দিন বাজার আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক শিবলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে মুন্সীগঞ্জের আলু রয়েছে। আমরা এসব আলু কেজিপ্রতি ৫৯ টাকায় বিক্রি করছি। পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানিকৃত আলু রয়েছে। এগুলো বিক্রি করছি কেজিপ্রতি ৪৮ টাকায়। ভারতীয় আলু সরবরাহে না থাকলে আলুর বাজার আরও অস্থির হয়ে যেত। কিন্তু ভারতীয় আলুর চেয়ে মুন্সীগঞ্জের আলুর স্বাদ ও চাহিদা বেশি।’
এই ব্যবসায়ী নেতা দাবি করেন, আলু নিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের কারসাজি বা সিন্ডিকেটে জড়িত নয়। মূল সমস্যা মুন্সীগঞ্জে। পাশাপাশি খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেকে এর চেয়ে বেশি দামেও বিক্রি করছে। এটা অন্যায়। তারা অতি মুনাফা করছে। এদেরও শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
নগরের নিমতলা এলাকার বাসিন্দা মো. ওমর ফারুক বলেন, আলুর বাজার লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্রে দেখেছি কৃষক ২৮ টাকা দরে আলু বিক্রি করেছে। সে আলু আমরা ৭০ টাকায় কিনে খাচ্ছি। নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা খুব চাপে সময় পার করছে। এটা খুব দুঃখজনক। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘রোজাকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- ভোজ্য তেল, ছোলা, আলু, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার এখন থেকেই অস্থির করে তুলছে একটি অসাধু চক্র। ঘুরেফিরে পুরনো সিন্ডিকেটরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বারবার শাস্তির আওতায় আনলেও তারা শুধরাচ্ছে না।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘নগরের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযানের পাশাপাশি ক্রয়-বিক্রয় রশিদ রাখা, ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রি করাসহ নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে ব্যবসায়ীদের সচেতন করে যাচ্ছি। ভোগ্যপণ্যের যে বাজারে যাচ্ছি সেখানে বাজার কমিটির সঙ্গে বৈঠক করছি। আমরা আলুর বাজারে আবার তদারকি করব।’