হোয়াইট হাউসে নিজের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার আগেই কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর অতিরিক্ত শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বিষয়ে গত সপ্তাহে ট্রাম্প বলেন, জানুয়ারিতে তার দায়িত্ব গ্রহণের পর কানাডা ও মেক্সিকো যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যুক্ত সীমান্ত সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তিনি দুই দেশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করবেন। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে কানাডীয় কর্মকর্তারা দ্রুত তাদের দেশের সীমান্ত সমস্যাগুলো মেক্সিকোর থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেন। এমন পরিস্থিতিতে কানাডার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা মেক্সিকোকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। খবর বিবিসির।
ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যমটির খবরে বলা হয়, কানাডার কর্মকর্তারা যুক্তি দেন যে, দক্ষিণ সীমান্তে (মেক্সিকো-কানাডা সীমান্ত) মাদক পাচার ও অবৈধ অনুপ্রবেশ অনেক বেশি এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য উত্তর আমেরিকায় মেক্সিকো একটি ‘পেছনের দরজা’ হিসেবে কাজ করছে।
তবে কানাডার এই মন্তব্যগুলো মেক্সিকোতে নজর এড়ায়নি। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবম চলতি সপ্তাহে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, ‘মেক্সিকোকে সম্মান করতে হবে, বিশেষত তাদের বাণিজ্য অংশীদারদের থেকে এটা আরও বেশি প্রত্যাশিত।’
শেইনবম বলেন, কানাডার নিজস্ব সামাজিক সমস্যা রয়েছে, যেমন ফেন্টানিল ব্যবহারের সমস্যা। এ সময় তিনি যোগ করেন, দেশটি (কানাডা) শুধু আশা করতে পারে যে, তাদেরও মেক্সিকোর মতো সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি থাকুক।
শেইনবমের এমন এক সময়ে এই মন্তব্য করেছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত কিরস্টেন হিলম্যানের ফরাসি সংবাদ সংস্থাটিকে জানান, সম্প্রতি ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাসভবন মার-আ-লাগোতে একটি ডিনারের সময়, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, উত্তরের সীমান্ত মেক্সিকোর সীমান্তের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন।
গত সপ্তাহে কানাডার সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ অন্টারিওর নেতা ডগ ফোর্ড বলেছেন, দুই সীমান্তের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে কানাডা ও মেক্সিকোকে একসঙ্গে বিবেচনা করা ‘সবচেয়ে অপমানজনক বিষয়’। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এটি শোনা কানাডার পক্ষে কোনোভাবেই কাম্য নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
খবরে বলা হয়, কানাডীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে চীনের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তারা বলছেন, তারা চীনের বিরুদ্ধে উদ্বিগ্ন যে, দেশটি মেক্সিকোকে ব্যবহার করে সস্তা আমদানির মাধ্যমে নিজেদের পণ্যে উত্তর আমেরিকার বাজার সয়লাব করে ফেলেছে।
অক্টোবরে চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) আমদানির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্কারোপ করে কানাডা। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনুরূপ ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া চীনের স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করার পরিকল্পনাও করছে কানাডা। তবে মেক্সিকো এখনো এ রকম উচ্চহারের শুল্ক আরোপ করেনি।
বর্তমানে তিনটি দেশই উত্তর আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তির অধীনে রয়েছে, যা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পুনরায় আলোচনা করা হয়েছিল। এই চুক্তি নিয়ে ২০২৬ সালে আবার আলোচনা করা হবে।
তবে চীনের সঙ্গে উত্তেজনার কারণে ডগ ফোর্ড বারবার কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে পৃথক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কানাডার জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ প্রদেশ আলবার্টার নেতা ড্যানিয়েল স্মিথ এই প্রস্তাবটি সমর্থন করেছেন।
এ বিষয়ে ডগ ফোর্ড নভেম্বরের শেষ দিকে বলেন, তাদের এই সমস্যাগুলো সমাধানের সুযোগ ছিল বহু বছর ধরে। কিন্তু তারা তা করতে চায় না। জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, কানাডা মেক্সিকোকে একটি ঐক্যবদ্ধ উত্তর আমেরিকান বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়। তবে যদি তারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিষয়গুলো সমাধান না করে, তাহলে আমাদের অন্য বিকল্প উপায়গুলো বিবেচনা করতে হতে পারে।
উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রস-বর্ডার ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মার্তা লিয়ার্ডি-অ্যান্ডারসন বলেন, ফোর্ডের মন্তব্য সম্ভবত অন্টারিওর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক নির্ভরশীলতার প্রতিফলন। উইন্ডসর শহরটি একটি সেতুর মাধ্যমে মিশিগানের ডেট্রয়েট শহরের সঙ্গে সংযুক্ত।
অন্টারিও প্রদেশ কানাডার অত্যন্ত সংহত অটো শিল্পের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে এবং ২০২৩ সালে অন্টারিও ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪৯৩ বিলিয়ন কানাডীয় ডলার (৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
এ বিষয়ে মার্তা লিয়ার্ডি-অ্যান্ডারসন বলেন, এটি দেশের যেকোনো একটি অঞ্চল থেকে আসা বিশাল পরিমাণ অর্থনৈতিক শক্তি। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক ও সীমান্ত নিরাপত্তা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘদিনের মিত্র মেক্সিকো ও কানাডাকে তাদের সম্পর্কের দুর্বলতাগুলো এমনভাবে বিশ্লেষণ করতে বাধ্য করেছে, যা তারা আগে করেনি।
এই মন্তব্যগুলো মেক্সিকোর প্রধান বাণিজ্য মধ্যস্থতাকারী গুতিয়েরেজ রোমানোর বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হয়েছে। তিনি গত সপ্তাহে কানাডার পত্রিকা গ্লোব অ্যান্ড মেইলকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভক্ত হওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
অন্যদিকে ডগ ফোর্ডের মন্তব্য এবং এ বিষয়ে ট্রুডোর নীরবতাকে কিছু মেক্সিকান জনগণের কাছে অপমানজনক হিসেবে মনে করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেক্সিকোর ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অলিভার সান্তিন পেনা।
পেনা বিবিসিকে বলেন, অবশেষে এটি কানাডা ও মেক্সিকোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ভালো সময় নয়। তিনি বলেন, দুই দেশ ৮৫ বছর ধরে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক উপভোগ করেছে।
মেক্সিকোর এই অধ্যাপক আরও বলেন, শেইনবমের প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত দেয় যে, প্রয়োজন হলে তিনি মেক্সিকোর জন্য দৃঢ় অবস্থান নেবেন। তবে ট্রাম্প ও ট্রুডোর সঙ্গে দ্বিমুখী বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করার ইচ্ছা সম্ভবত তার নেই। পেনা বলেন, তিনি (শেইনবম) উসকানিতে পা দেবেন না। তবে তিনি এটি পরিষ্কার করতে চান যে, তার দেশকে সম্মান করা উচিত।
শেইনবাউম, যিনি অক্টোবরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এখনো দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে মেক্সিকোকে তার উত্তর আমেরিকান প্রতিবেশীদের দ্বারা একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমান অংশীদার হিসেবে সম্মান করা উচিত। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবমকে যখন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি সবসময় মেক্সিকো ও মেক্সিকানদের অধিকার রক্ষা করব, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীরাও অন্তর্ভুক্ত।’
খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণ- উভয় সীমান্তেই অবৈধ অনুপ্রবেশ ও মাদক জব্দের ঘটনা ঘটছে। তবে সরকারি তথ্য অনুসারে, কানাডার সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তে এই সংখ্যাগুলো মেক্সিকোর সীমান্তের তুলনায় অনেক কম। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উত্তর সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত বাহিনী ৪৩ পাউন্ড (সাড়ে ১৯ কেজি) ফেন্টানিল (মাদক) জব্দ করেছে, যেখানে দক্ষিণ সীমান্তে এই পরিমাণ ২১ হাজার পাউন্ডের বেশি। একই সময়ে উত্তর সীমান্তে প্রায় ২ লাখ অভিবাসীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আর দক্ষিণ সীমান্তে এই সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। তবে ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত শুল্ক হুমকির পর থেকে সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কানাডা।