সম্প্রতি মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনে তেল সরবরাহের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে বহির্নোঙরে লাইটারিংয়ের মাধ্যমে তেল পরিবহনে রাষ্ট্রীয় দুটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের পর এই বিষয়টি আরও গুরুত্ব পেয়েছে। তেল সরবরাহের জন্য গত বছরের ডিসেম্বরে পাইপলাইনটি নির্মাণ করা হলেও, এখনো তেল সরবরাহ শুরু হয়নি। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) দোষারোপ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বর্তমানে বছরে ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত তেল পরিবহন করে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)-এর দুটি জাহাজের মাধ্যমে। বহির্নোঙর বাংলার জ্যোতি এবং বাংলার সৌরভে লাইটারিং করে কর্ণফুলী নদীর ডলফিন জেটি থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তেল সরবরাহ করা হতো।
তবে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। একদিকে লাইটারিং অপারেশনে অনেক সময় ব্যয় হয়- তেল খালাসে ১২ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। অপরদিকে, জাহাজে দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকে। এই কারণে তেল পরিবহন প্রক্রিয়া দ্রুত ও নিরাপদ করার জন্য কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত একটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়।
এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করা গেলে, তেল পরিবহন আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী হতো। পাশাপাশি তেল পরিবহনের সময় কমানো, জাহাজের দুর্ঘটনা এড়ানো এবং পরিবহন খরচ কমানো সম্ভব হতো।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০ লাখ টন, যার মধ্যে ১৫ লাখ টন সরবরাহ হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে।
গভীর সমুদ্র থেকে তেল সরবরাহের নতুন প্রক্রিয়া ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পের আওতায় গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু হয়। সৌদি আরব থেকে আমদানি করা প্রায় ৮২ হাজার টন অপরিশোধিত তেল খালাসের জন্য ভাসমান মুরিং পয়েন্টে পাম্পের মাধ্যমে মহেশখালীতে ট্যাংক ফার্মে স্টোর করা হতো।
এ প্রক্রিয়ায় তেল খালাস করতে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগত, যা আগের লাইটারিং অপারেশনে ১২ থেকে ১৪ দিনের তুলনায় অনেক দ্রুত। সময় সাশ্রয় ও খরচ কমানোর পাশাপাশি এসপিএম পদ্ধতির মাধ্যমে বছরে ৮০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর ত্রুটি ধরা পড়ে এবং তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ত্রুটি মেরামত করে মার্চ মাসে আবার চালু করার চেষ্টা করা হয়, তবে আরও সমস্যা দেখা দেয় এবং পাইপলাইনে তেল সরবরাহ আবারও বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৫ সালে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্প গ্রহণ করে বিপিসি। চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু নানা কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় এবং ব্যয়ও বেড়ে ৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকায় পৌঁছায়। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু চতুর্থ দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ হয়।
এই প্রকল্পের অধীনে দুটি সমান্তরাল পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে, যার একটি অপরিশোধিত তেলের জন্য এবং অন্যটি ডিজেলের জন্য। মহেশখালীতে একটি ভাসমান মুরিং পয়েন্ট এবং স্টোরেজ ট্যাংক টার্মিনাল রয়েছে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল সরবরাহ হলে, সময় সাশ্রয় হবে ও পরিবহন খরচও কমবে।
বর্তমানে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ অন্যান্য তেল মজুদাগার রয়েছে। এখানকার ছোট জাহাজ ঘাটগুলোতে বড় ট্যাংকার থেকে তেল স্থানান্তর করার জন্য সময় বেশি লাগে, যার ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যায় এবং তেলও অপচয় হয়। আরও বিপদজনক হলো, এই প্রক্রিয়ায় চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে পাইপলাইন চালু হলে, এসব সমস্যা দূর হবে।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিবহন) অনুপম বড়ুয়া জানিয়েছেন, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পের অধীনে দুইটি পাইপলাইন চালু হলে লাইটারিংয়ের ঝামেলা ও অন্যান্য সমস্যাও দূর হয়ে যাবে। তিনি আশা করছেন, কিছু দিনের মধ্যে পাইপলাইনটি পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত হয়ে তেল সরবরাহ শুরু হয়ে যাবে। এর ফলে লাইটারিং জাহাজের প্রয়োজন আর পড়বে না এবং তেল পরিবহন আরও দ্রুত ও নিরাপদ হবে।
তবে বহির্নোঙর থেকে তেল সরবরাহের জন্য রাষ্ট্রীয় দুটি জাহাজের দুর্ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে তেল সরবরাহ বিঘ্নিত করেছে। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, এমটি বাংলার জ্যোতির বিস্ফোরণ ঘটলে তিনজন নাবিক নিহত হন। পরে ৪ অক্টোবর বাংলার সৌরভে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যার ফলে সাদেক মিয়া নামে এক নাবিক নিহত হন। এসব দুর্ঘটনার পর বিপিসি এবং বিএসসি অন্যান্য জাহাজ ভাড়া করে তেল সরবরাহের কাজ অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে দেশের তেল সরবরাহ চেইন সচল রয়েছে।