
গত বছরের এই সময়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা কেজি। এবার সারা দেশের আমন ধান উঠে গেছে। তারপরও বাজারে মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকার কমে মেলে না। মাঝারি আটাশ ও সরু চালের দাম আরও বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে ৬০-৭০ টাকার সরু চাল বর্তমানে ৬৮ থেকে ৮০ টাকায় ঠেকেছে। ৫২ থেকে ৫৫ টাকার আটাশ ৫৮ থেকে ৬৩ টাকা কেজি। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশেরই (টিসিবি) এই তথ্য। বাজারেও এ রকম বাড়তি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিস্টরা বলছেন, মিলের মালিকরা ইচ্ছামতো মজুত করে বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন। এ জন্য অস্থিরতা কাটছে না।
খাদ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক মো. আব্দুস সালাম খবরের কাগজকে বলেন, দেশে বিভিন্ন গুদামে খাদ্য মজুত পরিস্থিতি ভালো। গত ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধান, চাল ও গম মজুত ছিল। তারপরও আমনের ভরা মৌসুমে বাড়ছে চালের দাম।
চলতি বছরের শুরু থেকেই চালের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। জুলাই-আগস্টে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে কেজিতে ৩-৫ টাকা বাড়ে। এ নিয়ে দেশে হইচই শুরু হলে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নেয় চালের দাম কমানোর। আগে চালের ওপর আমদানি শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, অগ্রিম আয়কর এবং আগাম কর মিলে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ ছিল। দাম কমাতে সরকার গত ২০ অক্টোবর চালের ওপর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু তাতেও আমদানিকারকরা তেমন সাড়া দেননি। তাই আমদানি পর্যায়ে সব শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করে এনবিআরকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। তা আমলে নিয়ে গত ১ নভেম্বর চাল আমদানিতে শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণ শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ বাদ দিয়ে শুধু ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রাখা হয়েছে। তাতে চালের আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমার কথা জানায় এনবিআর।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। এ ব্যাপারে বেনাপোল বন্দরের রাতুল এন্টারপ্রাউজের স্বত্বাধিকারী আব্দুল লতিফ খবরের কাগকে বলেন, ‘ গ্রামে বেশি মোটা চালের চাহিদা। সরকার ভারত থেকে আমদানির সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু ডলারের দাম বেশি হওয়ায় ভারতের চালের দামই বেশি পড়ছে। দেশে আনতে ৫১ থেকে ৫২ টাকা কেজি পড়ে যাচ্ছে। অথচ দেশেই মোটা চাল তার চেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য কেউ আমদানি করছেন না।’
রাজধানীতে কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার, বাদামতলী ও কৃষি মার্কেট সরেজমিনে গেলে পাইকারি ও খুচরা চাল বিক্রেতারা বলেন, ‘ভারতের চাল আসে না। কারণ দেশে এর চেয়ে কম দামে চাল পাওয়া যাচ্ছে।’ এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স হাজি রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. মাইনুদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারতের কোনো চাল আসে না। তাই বিক্রিও করি না। দেশেই তার চেয়ে কম দামে চাল বিক্রি হচ্ছে।’
কারওয়ান বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা বাহার ট্রেডার্সের বাহার মিয়াসহ অন্য চাল বিক্রেতারা বলেন, ‘সরকার যতই শুল্ক কমাক দাম কমবে না। কারণ ভারতে চালের দাম বেশি। আবার দেশে আমন ধান উঠলেও চিকন চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা। মিলাররা বলছেন, ধান নেই। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে মিনিকেট ৭২-৭৬ টাকা, আটাশ চাল ৫৮-৬০ টাকা ও মোটা চাল ৫০-৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে।’
কৃষি মার্কেটের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স এম এম রাইস এজেন্সির ফিরোজ মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে করপোরেট সিন্ডিকেট। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। রশিদ, সাগর মঞ্জুর গ্রুপসহ করপোরেটরা বস্তায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বাড়িয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দেশে পর্যাপ্ত ধান রয়েছে। বোরো ধান ওঠার পর থেকেই তারা দাম বাড়াচ্ছেন। ব্যাংক থেকে বেশি করে ঋণ নিয়ে মিলাররা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করছেন। ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। এর প্রভাব ভোক্তাদের ওপর পড়ছে। বর্তমানে পাইকারি মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭০ টাকা, আটাশ চাল ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা , বিআর ১৭ বা স্বর্ণা চাল ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা এবং মোটা চাল ৪৮-৪৯ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঋণের টাকায় মিলাররা বেশি করে ধান মজুত করছেন। তাই ব্যাংকঋণ বন্ধ করতে হবে। তাহলে তারা সিন্ডিকেট করে ধান ও চাল মজুত করতে পারবে না। সরকারকে এদিকে নজর বাড়াতে হবে।’
টিসিবি বলছে, গত বছরের এই সময়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা কেজি। এবার সারা দেশের আমন ধান উঠে গেছে। তারপরও বাজারে মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। মাঝারি আটাশ ও সরু চালের দাম আরও বেড়েছে। গত বছরে এই সময়ে ৬০-৭০ টাকার সরু চাল বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৬৮ থেকে ৮০ টাকা কেজি ঠেকেছে। ৫২ থেকে ৫৫ টাকার আটাশ চাল ৫৮ থেকে ৬৩ টাকা কেজি বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা।