
চলমান অর্থনৈতিক অবস্থায় শিল্প খাতে নানা কারণে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ালে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বন্ধ হয়ে যাবে অনেক শিল্প-কারখানা। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ) নেতারা।
তারা বলছেন, বর্তমানে কারখানায় যেসব প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের যে খরচ তার প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ। সরকার যদি আবারও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে উৎপাদন খরচের ৯০ শতাংশই চলে যাবে গ্যাস আর বিদ্যুতের দাম পরিশোধে।
রবিবার (১২ জানুয়ারি) বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিপিএমইএ) আয়োজিত পল্টনে সংগঠনের নিজস্ব কার্যালয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও সিঙ্গেল প্লাস্টিক ব্যবহারবিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, ‘১৭ কোটি মানুষ যেখানে পলিথিনের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে এটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাও মনে করি পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা উচিত। কিন্তু এর বিকল্প কিছু তৈরি করে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছিলাম যে, একেবারে পাতলা যে পলিথিন আছে, এমন তিন ক্যাটাগরির পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করার জন্য। সরকারকেও এ বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।’
সামিম আহমেদ বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে গ্রাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু তারা গ্যাসসংকটের সমাধান করতে পারেনি। অনেক এলাকায় গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে শিল্প-কারখানা চলছে রেশনিং পদ্ধতিতে। অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাসসংকটের সমাধান না করে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে শিল্প-কারখানায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
বিপিজিএমইএ সভাপতি বলেন, গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শুভঙ্করের ফাঁকি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতিসহ শিল্প-কারখানা রক্ষায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত। গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি পড়বে। তখন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া সামাল দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, পেট্রোবাংলা দুটি উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে। দেশি গ্যাস কিনে নেয় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে। এতে প্রতি ইউনিটে তাদের গড়ে খরচ হয় ৬ টাকা ৭ পয়সা। কিন্তু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে খরচ হচ্ছে ৭৫ টাকার বেশি। এতে লোকসানে আছে সংস্থাটি। ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। তাই এখন এলএনজি আমদানির খরচ পুরোটাই শিল্পের ওপর চাপাতে চাইছে পেট্রোবাংলা।
তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিকের একটি ভালো দিক হচ্ছে এটি পুনর্ব্যবহার করা যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, আমরা বর্তমানে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইক্লিং করছি, যা বিশ্বের অনুমোদিত ১০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সরকারিভাবে প্লাস্টিক বন্ধ না করে রিসাইক্লিংয়ের বিষয়ে বেশি উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সামিম আহমেদ বলেন, ‘তৈরি পোশাক, এসি রেস্তোরাঁ, নন-এসি রেস্তোরাঁ, মিষ্টিসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কোনো আলোচনা ছাড়া ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অবিবেচনাপ্রসূত। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। আমরা মনে করি, ভ্যাট কম হলে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।’
এ সময় বিপিজিএমইএ উপদেষ্টা ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে শিল্প বিঘ্নিত করা কোনো সমাধান নয়। গ্যাসকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা উচিত। গৃহস্থালি বা সিএনজিতে গ্যাস ব্যবহারে কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই। প্রয়োজনে বাসাবাড়িতে গ্যাস বন্ধ করে দিন, সিএনজি বন্ধ করুন। কিন্তু শিল্প ধংস হলে সব শেষ হয়ে যাবে। হুট করে দাম এত বাড়লে তারা (শিল্প উদ্যোক্তারা) ব্যবসা করবেন কীভাবে?’
বিপিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এ এস এম কামাল উদ্দিন বলেন, সরকারের মধ্যে এখনো ঘাপটি মেরে আছে পুরোনো দোসররা। তারা দেশের শিল্প ধংসের চক্রান্তে এখনো লিপ্ত।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়লে আমরা ভারত-চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারব না। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববাজারে যে একটি বড় অবস্থান তৈরি হয়েছে, সেটা আমরা হারাব।’
সংবাদ সম্মেলনে এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিপিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এ এস এম কামাল উদ্দিন, ফেরদৌস ওয়াহেদ, সিনিয়র সহসভাপতি কে এম ইকবাল হোসেন, সহসভাপতি কাজী আনোয়ারুল হক, পরিচালক সৈয়দ নাসির উদ্দিন, ঝন্টু কুমার দাস, বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, প্রাণ-আরেএফএল গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক কামরুল ইসলাম, ডিউরেবল প্লাস্ট্রিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌকিরুল আলম, আকির বায়াক্সের পরিচালক মফিজুল ইসলাম ইরাজ।