ব্যাপক সমালোচনা ও চাপের মুখে ৯টি পণ্য ও সেবায় বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। তবে এখনো বেশির ভাগ পণ্য ও সেবায় তা রয়েই গেছে। ব্যবসায়ীরা বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানালেও আমলে নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে ব্যবসায়ীরাও দাবি আদায়ে অনড় রয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে খরচ বেড়েছে অনেক খাতে। ব্যবসায়ীরা করোনার সময়ে ব্যবসা করতে পারেননি। করোনার পর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের প্রভাবে এখনো আমরা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমাদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। বাড়তি চাপ সামলাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।’
একই মত জানিয়ে এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবি বাস্তবায়ন হতে দেখছি না। আশা করি এনবিআর বিষয়টি বিবেচনা করবে।’
বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন জারির পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করেও বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছে। অটোমোবাইল ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের ব্যবসায়ীরা রাজপথে নামেন। এনবিআরের সামনে অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করা হয়।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত মাসে (জানুয়ারি) অধ্যাদেশ জারি করে কয়েকটি খাতে পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পরামর্শে কিছু খাতের বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক সমন্বয় করা হয়েছে। আরও অনেকে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। তাৎক্ষিণকভাবে এসব কমানো সম্ভব নয়। অনেক হিসাবের বিষয় আছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এসব বিষয় নিয়ে ভেবে দেখা হবে। নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
গত এক মাসে অনেক ব্যবসায়ী ব্যক্তিগতভাবে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়েছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এক জোট হয়ে দেখা করে একই দাবি করেছেন। তবে এসব বৈঠক থেকে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানো হবে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট, কর ও শুল্কহার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ না পড়ে। ভ্যাট, কর ও শুল্কের ভারে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে রাজস্ব পরিশোধ করবেন কীভাবে? বিষয়টি সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। তাই ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ভ্যাট, কর ও শুল্কহার ধার্য করা প্রয়োজন।’
তিনি হিসাব কষে বলেন, ‘আমরা প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে আম, টমেটো, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য কিনে প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ড্রিংকস, আচার, সস তৈরি করি। টমেটো, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্পের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে খরচ বাড়বে। বর্ধিত ভ্যাটের কারণে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়ার কারণে অনেকেই এসব পণ্য কিনবেন না। এভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ায় ব্যবসা কমিয়ে আনতে হবে। কারখানা বন্ধ হলে অনেক শ্রমিক বেকার হবেন।’
বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে এনবিআরে আবেদন করা হয়েছে। এসব আবেদনে অর্থবছরের মাঝামাঝি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ে খরচ বেড়েছে অভিযোগ করে আরোপিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিত্যপণ্যে যদি ভ্যাট থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে ব্যবসা করবেন? এরই মধ্যে আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর জোরালো আবেদন করেছি। কিন্তু আমাদের দাবি এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। কবে বাস্তবায়ন করা হবে তার আশ্বাসও পাওয়া যায়নি।’
বর্ধিত ভ্যাট কমানোর দাবিতে এনবিআরে জমা দেওয়া আবেদনে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) থেকে বলা হয়েছে, সংগঠনের প্রায় ৪০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এর বাইরেও পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। কাঁচামাল সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতাসহ পরোক্ষভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ খাতে যুক্ত। হঠাৎ এ ধরনের উদ্যোগে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি। আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের সুপারশপেও এখন বাংলাদেশে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। এ খাতে রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এখন বর্ধিত ভ্যাট আরোপের ফলে এ খাত মুখথুবড়ে পড়বে। ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাছে বাজার হারাবে বাংলাদেশ।
বাপার সভাপতি এম এ হাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের ফলে দাম বেড়ে গেলে পণ্য কেনা কমিয়ে দেবেন ভোক্তারা। স্বাভাবিকভাবে কোম্পানিগুলোও কাঁচামাল হিসেবে কৃষিপণ্য সংগ্রহ কমিয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। তারা ফসলের ভালো দাম পাবেন না।’
এনবিআরে জমা দেওয়া ব্যবসায়ী সংগঠনের আবেদনে হিসাব কষে দেখানো হয়েছে, ভ্যাটের হার বাড়িয়ে অনেক খাতে ১৫ শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। এ হারের সঙ্গে বিভিন্ন ধাপে ভ্যাট যোগ হয়ে শেষ পর্যন্ত ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে ভোক্তাকে। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৫-১৬ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপের কারণে ব্যবসা ও শিল্পে মুনাফা কমবে। অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়বে।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাটের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক মনে করি না। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। মনে রাখতে হবে, এনবিআর ও ব্যবসাযীরা একে অন্যের সহযোগী, প্রতিপক্ষ না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের চাপে রেখে অর্থনীতি গতিশীল করা যায় না। বরং ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করে, রাজস্ব ছাড় দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল করতে হবে। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে।’