একসময়ে এ দেশের খামারিরা দেশ-বিদেশে বাগদা, গলদা, হরিণাসহ বিভিন্ন জাতের চিংড়ির রমরমা ব্যবসা করলেও গত কয়েক বছরে তা কমেছে। বিশ্বব্যাপী জায়গা করে নিয়েছে ভেনামি চিংড়ি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে এখনো ভেনামি চিংড়ির চাষ সাধারণ খামারি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ খামারিদের ভেনামি চিংড়ি চাষে আগ্রহী করতে হলে সরকারকে অল্প সুদে ঋণ, নগদ ও নীতি সুবিধা দিতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলারসংকটর কারণে সব ধরনের চিংড়ি উৎপাদনেই খরচ বেড়েছে। খরচ কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে সাধারণ মানুষ কম দামে চিংড়ি কিনতে পারবেন। রপ্তানিও বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন মেনে ভেনামি চিংড়ি চাষ করতে হয়। তা না হলে এসব চিংড়ি সহজে মরে যায়। ফলে খামারিরা লোকসানে পড়বেন। এ জন্য সরকারকে ভেনামি চাষে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।
বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারকরা বলছেন, বর্তমান বিভিন্ন দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির সিংহভাগই ভেনামি। হিমায়িত করে এসব চিংড়ি রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির বেশির ভাগই বাগদা। চিংড়ির উচ্চফলনশীল জাত ভেনামির চাষও পুরোপুরি শুরু হয়নি। এতে স্বাভাবিকভাবেই হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমেছে। গত অর্থবছর তার আগের অর্থবছরের তুলনায় হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমেছে ২৫ শতাংশ। এতে চিংড়ির রপ্তানি প্রায় ৪১ কোটি ডলার থেকে কমে গত বছর ৩২ কোটি ডলারে নেমেছে।
ভেনামি উচ্চফলনশীল পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উন্নত জাতের চিংড়ি। উচ্চফলনের পাশাপাশি প্রতিরোধক্ষমতার জন্যও এই চিংড়ি সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত চিংড়ির ৮০ শতাংশই ভেনামি জাতের। দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি চেয়ে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দেনদরবার করেছেন রপ্তানিকারকরা। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে- এ যুক্তিতে শুরুতে ভেনামি চাষে উৎসাহ বা অনুমতি কোনোটিই দেয়নি মৎস্য অধিদপ্তর। বাংলাদেশ ২০১৯ থেকে এ চিংড়ির পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। চার বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদনে অনুমতি দিয়েছে সরকার। বছর দুয়েক থেকে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি ভেনামি চিংড়ি চাষে যেতে পারেনি।
মৎস্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভেনামি চিংড়ি চাষে বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিত করতে পানি ও বর্জ্য শোধন, ভৌত অবকাঠামোর বিচ্ছিন্নতা, বায়ু সঞ্চালন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, রোগের তথ্য সংরক্ষণ, খাদ্য প্রয়োগসহ অন্যান্য তথ্যও হালনাগাদ রাখতে হবে। সনাতন পদ্ধতির বদলে আধা নিবিড় বা নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চিংড়ির চাষ করতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ এ চিংড়িকে যথাযথভাবে মানসম্মত খাদ্য দিতে হবে। কোনোভাবেই অননুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক, রাসায়নিক বা কীটনাশক প্রয়োগ করা যাবে না। আর বাজারজাত করার ৮ থেকে ১০ দিন আগে চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিতে হবে। কোনো কারণে ভেনামি চিংড়িতে রোগ দেখা দিলে মৎস্য অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মৎস্য হ্যাচারি আইন, মৎস্য হ্যাচারি বিধিমালা ও মৎস্য সংগনিরোধ আইন অনুসরণ করে দ্রুত ওই সব সংক্রমিত চিংড়ি ধ্বংস করতে হবে। রোগাক্রান্ত খামার সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করে আবার উৎপাদনে যেতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের চাষিরা ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে আগ্রহী খামারিদের বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষের জন্য বায়োসিকিউরিটি, সংগনিরোধসহ ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা থাকতে হবে। অনুমোদন পেতে আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত ছকে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হবে। অনুমোদিত খামারের নির্বাচিত স্থানের বাইরে ভেনামি চিংড়ি চাষ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার ওইসি ওয়ার্ল্ডের তথ্যানুযায়ী, গত কয়েক বছরে বিশ্ব চিংড়ি রপ্তানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ রপ্তানি করেছে ইকুয়েডর। তারপর ভারত ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, ভিয়েতনাম ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও আর্জেন্টিনা ৫ শতাংশ রপ্তানি করেছে। বিশ্ব চিংড়ি রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
ভেনামিতে সফল হতে ভারতের ৫-১০ বছর সময় লেগেছে। বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ময়মনসিংহে চিংড়ি চাষ হয়। রপ্তানির জন্য বড় মাপের শতাধিক চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে। বড় মাপের ৩০টির মতো কারখানায় ভেনামি চিংড়ি চাষ হচ্ছে।
বাণিজ্যিক চিংড়ি খামার রাসনা হ্যাচারির মালিক আবদুল খালেক খবরের কাগজকে বলেন, দুই দশক আগে থেকে দামে সস্তা হওয়ায় দুনিয়াজুড়ে
ভেনামি চিংড়ির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাংলাদেশে এসব চিংড়ির চাষ বাড়াতে হবে। এর জন্য সরকারকে সহায়তা দিতে হবে।
সাহানা মৎস্য ফার্মের মালিক রণজিত সাহা খবরের কাগজকে বলেন, চিংড়ির ব্যবসা বলতে এখন ভেনামি চিংড়ি চাষ করা হয়। ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক লাভ কতটা, তা সাধারণ খামারিরা জানতে পারলে ভেনামি চিংড়ি চাষে আগ্রহী হবেন। এ জন্য সরকারকে ভেনামি চাষের ভালো দিকগুলো নিয়ে প্রচার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ভেনামি চাষে আগ্রহী করতে সরকারকে নগদ সহায়তা দিতে হবে। নীতি-সহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে অল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। এসব সুবিধা পেলে সাধারণ খামারিরা ভেনামি চিংড়ি চাষে আসবেন। এতে সারা দেশের চিংড়ির চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা রয়েছে। উৎপাদন বাড়লে রপ্তানিও বাড়বে।
হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি আমিন উল্লাহ বলেন, ভেনামিতে সফল হতে ভারতের ৫-১০ বছর সময় লেগেছে। ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশেরও সময় লাগবে। ভেনামি চাষ সফল করতে চাষিদের মূলধনের জোগান দিতে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে বাগদা চাষে প্রতি একরে ১-২ লাখ টাকা লাগে। ভেনামি করতে হবে সেমি-ইনসেনটিভ পদ্ধতিতে। তাতে প্রতি একরে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে। তবে খরচ বাড়লেও উৎপাদন কয়েক গুণ বেশি হয়। ফলে লাভ থাকে।’
এমইউ সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাগদা চিংড়ি রপ্তানিতে টিকতে হলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। যুদ্ধের আগে এক পাউন্ড চিংড়ির (মাথাবিহীন ১৬-২০ পিস চিংড়ি) দাম ছিল গড়ে ১৪-১৫ ডলার। এখন গড়ে ১০-১১ ডলারের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের হ্যাচারিতে যেসব পোনা পাওয়া যায়, সেগুলোর স্বাস্থ্য ভালো, রোগবালাইও কম। আমাদের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি মানসম্মত পোনার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।