
আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অসংগতি নীতি। প্রতিবছর আমরা ভয়ভীতির মধ্যে থাকি বাজেট কর বাড়বে কি কমবে। গ্যাস সরবরাহে সিস্টেম লসের নামে ১০ শতাংশ চুরি বন্ধ করা গেলে নতুন করে গ্যাসের দর বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই পারে এ চুরি বন্ধ করতে। কারণ, তাদের ভোটের প্রয়োজন নেই।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) রাজধানীর পল্টনে অর্থনৈতিক বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যালয়ে ‘বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। ইআরএফ এ সেমিনারের আয়োজন করে।
এ সময় সেমিনারের প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘আগামী ৭ থেকে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশে বিনিয়োগ সামিট (ইনভেস্টমেন্ট সামিট) অনুষ্ঠিত হবে। এই সামিটের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আহ্বান জানানো হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে কী কী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তাও জানানো হবে। বিরাজমান সমস্যাগুলো দূর করতে সরকার কী করছে, তাও জানানো হবে। আশা করি, এতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়বে।’
সেমিনারে ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, প্রশাসক হাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, লাফার্জহোলসিমের সিইও ইকবাল চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সঞ্চালনা করেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিডার ব্যবসায়িক উন্নয়নপ্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি।
ভ্যাট পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিডার চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ভ্যাটের বিষয়টি নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
গ্যাস পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকা উচিত। মালয়েশিয়ার উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, দেশটিতে উৎপাদিত গ্যাসের ৭০ শতাংশই শিল্পে ব্যবহার হয়। গ্যাসের বরাদ্দ শিল্প মন্ত্রণালয়ই করে থাকে।
শিল্পে গ্যাস সরবরাহসংকটে উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ প্রসঙ্গে বিডার চেয়ারম্যান বলেন, ‘বন্ধ শিল্পকারখানা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এরই মধ্যে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ সুবিধা রয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করে সেখানে এসব সুবিধা সরকার নিশ্চিত করতে পারছে না। তাই আপাতত অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের দিকে যাচ্ছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। আমরা চেষ্টা করছি সহজ সেবা নিশ্চিত করতে। এ জন্য অন্য সব প্রতিষ্ঠানকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবাগুলো যাতে বিনিয়োগকারীরা পায়, তার জন্য কাজ করা হচ্ছে।’
বিডার চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এর জন্য আমরা প্রতি মাসেই সেমিনার করব, প্রতি মাসেই বিনিয়োগে আগ্রহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসব। সবার সমস্যা শোনা হবে। প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হবে। আশা করি, এসবের ফলে ভালো ফল আসবে।’
নতুন করে গ্যাসের দর বৃদ্ধি ও ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর সমালোচনা করে এ কে আজাদ বলেন, ‘সরকার যে নীতি নিচ্ছে এগুলো বাস্তবায়িত হলে আমরা কোথায় যাব? গ্যাস ও ভ্যাট বৃদ্ধির আগে অর্থনীতি ও জনজীবনে এর কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখা হয়নি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও করা হয়নি।’
তিনি বলেন, পণ্য আমদানি, রপ্তানি ও মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে। এই চিত্র বলছে, বিনিয়োগ কমেছে। অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে গ্যাস ও ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে তা চিন্তা করা উচিত।
এ কে আজাদ আরও বলেন, ব্যবসায়ী মানেই যেন অপরাধী। সবাই চুষে খেতে চায়। অনিয়মে অন্তত ৪০ শতাংশের মতো ব্যয় করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে সব সরকারের চরিত্রই এক। গত সরকার বলেছিল গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করবে। কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে একবার এসে বিনিয়োগ করলে কান ধরে চলে যান। এটা খুবই হতাশাজনক।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে নীতির অসংগতি। বাংলাদেশে পলিসি আনপ্রেডিক্টেবল। প্রতিবছর আমরা ভয়ভীতির মধ্যে থাকি যে বাজেট কর বাড়বে কি কমবে। বিডা চেষ্টা করছে বড় বড় বিনিয়োগকারী দেশে আনার জন্য। তারা বিভ্রান্তিতে থাকে যে ট্যাক্স বাড়বে কি না?’
আবুল কাসেম খান বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে আমরা একই কথা বলে আসছি কেন বাংলাদেশে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগকারীদের একটা কমন প্রশ্ন থাকে যে বাংলাদেশ ট্যাক্স রেটটা কত আসলে। কেউ বলে ২৭ শতাংশ, কেউ বলে ৩৬ শতাংশ, কেউ বলে ৪৮ শতাংশ, কেউ বলে ১২ শতাংশ। কোনো বেঞ্চমার্ক নেই। কারণ এত স্টেজে বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স রেট নির্ধারণ হচ্ছে যে কার্যকর ট্যাক্স রেটের মৌলিক কোনো কাঠামো নেই। এটা হচ্ছে বিনিয়োগের প্রথম বাধা।’
তিনি বলেন, ‘তার সঙ্গে আছে নীতির অসংগতি। সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) দিয়ে পলিসি চেঞ্জ করে দেওয়া হচ্ছে। এ রকম অনিশ্চয়তার মধ্যে একজন বিনিয়োগকারী যখন বিনিয়োগ করেন তিনি তো দীর্ঘমেয়াদি একটা পরিকল্পনা নিয়ে আসেন। যেকোনো ক্ষেত্রে ইনসেনটিভ দিলে সেটা দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে।’
সাবেক সভাপতি আরও বলেন, ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোনের (এসইজেড) পলিসিতে প্রথমে বলা হয়েছিল, তা প্রাইভেট সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট করবে। পরে আবার সরকার মিরসরাই করে কম্পিটিশন বাড়িয়ে দিল। সরকার যে লেভেলে এসইজেড দিতে পারবে, বেসরকারি খাত সেই লেভেলে দিতে পারবে না। কারণ সরকারের সক্ষমতা আছে। আজ আমরা এসইজেডে ইনভেস্ট করে ধরা খেয়ে আছি।’
তিনি বলেন, প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশনে বাংলাদেশে কোনো সময়সীমা নেই। কোনো প্রজেক্ট শুরু হতেই অনেক বছর লেগে যায়। ফলে রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট মিলবে না। এরপর আছে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউর হয়রানি। যারা ভালো ট্যাক্স দিচ্ছে তাদের ওপর চাপ আসছে। পরের বছর আবার অডিট করছে।
আবুল কাসেম খান বলেন, ‘আমি মনে করি, পলিসির ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরকে যুক্ত করা দরকার। তাদের নিয়ে পলিসি করলে তারা কমপ্লেইন করতে পারবে না। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার, সব কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন করে তৈরি করতে হবে। প্রধান উদ্দেশ্যে হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করা। প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। টেকসই ব্যবসা করার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। লজিস্টিকস এবং পরিবহন ব্যয় ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে, যা এখন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।’
তিনি বলেন, ‘সাপ্লাই চেইন মেকানিজমে আমরা অনেক দুর্বল, সবকিছু আমাদের আমদানি করতে হয়, এদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের ব্যাকএন্ড সাপ্লাই চেইন মেকানিজম নেই। আবার ফরেন এক্সচেঞ্জ সীমাবদ্ধতার জন্য প্রযুক্তি ট্রান্সফার হচ্ছে না। আমাদের কস্ট অব ডুইং বিজনেস (ব্যবসার খরচ) অনেক বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের হুটহাট পলিসি পরিবর্তন করা হয়। এটাই হলো বিনিয়োগের প্রধান বাধা। দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষই যুবক-তরুণ, যাদের বয়স ৩০-এর মধ্যে, এদের সবাইকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। উদ্যোক্তা বানাতে হবে। কাজ দিতে হবে।’
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভ্যাট ট্যাক্সের সিস্টেম ও ব্যবস্থাপনা আমাদের অনেক উদ্যোক্তাকে ভীতিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে যা হচ্ছে তা নিয়ে বিভ্রান্তিতেও রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।’