রোজাদারের জন্য খেজুরের মতো ছোলাও ইফতারির জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হয়ে গেছে। অভিজাত পরিবার থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষেরও ইফতারির থালায় ছোলা থাকে। রমজান মাসে এর চাহিদা বেড়ে যায়। এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়ানোর সুযোগ নেয়।
গত রমজানে হঠাৎ কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে যায়। রমজান সামনে রেখে এবার প্রচুর ছোলা আমদানি হওয়ায় বাজারে ছোলার সরবরাহ বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আসন্ন রমজানে ছোলার দাম বাড়বে না। বরং কমবে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও বর্তমানে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় নেমেছে। এক মাসের ব্যবধানে ১০ থেকে ১৭ শতাংশ কমেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বার্ষিক ছোলার চাহিদা দেড় লাখের মতো। সে হিসাবে মাসে লাগে সাড়ে ১২ হাজার টন। কিন্তু দেশে খুবই কম উৎপাদন হয়। আমদানি করেই চাহিদা মেটাতে হয়। রমজানে চাহিদা দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৫ হাজার টনে দাঁড়ায়। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘নাবিল গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা ছোলা আমদানি করে। তারা দাম বাড়ালেই বাজারে বেড়ে যায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারে আমদানি বেশি হওয়ায় দাম কমেছে ছোলার। সরকারি সংস্থা টিসিবিও বলছে, গত বছরের রমজানের আগে ৮৫-৯০ টাকা কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে। কিন্তু রমজানে বেড়ে ৯৫ থেকে ১১০ টাকায় ঠেকে। রমজান শেষে চাহিদা কমে গেলেও দাম কমেনি। বরং ডলারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে ছোলার দাম ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় পৌঁছে। টিসিবির তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসেও ১২০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে ছোলা। কিন্তু রমজান ঘনিয়ে আসায় আমদানিও প্রচুর বেড়েছে। এ জন্য দাম কমতে শুরু করেছে। পাইকারি পর্যায়ে ৯৫ টাকায় নেমেছে। সেই ছোলা বাজারে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে চাহিদার ৮০ শতাংশ ছোলা আমদানি হয়। বাকি ছোলা ভারত, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেন, তানজানিয়া, মায়ানমার ও কানাডা থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকারকরা এবার বিশ্ববাজার থেকে কম দামে ছোলা সংগ্রহ করছে। এ জন্য দামও কমেছে।
গত বছর থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তাই আসন্ন রোজায় আট ধরনের খাদ্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ন্যূনতম পর্যায়ে নগদ মার্জিন রাখতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ১৭ জানুয়ারি এক নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দেয়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মতো ব্যাংক-গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে নগদ এ মার্জিনের হার নির্ধারণ করতে হবে। ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে।
অভ্যন্তরীণ বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানির ঋণপত্র খোলায় অগ্রাধিকার দিতে বলা হয় নির্দেশনায়। তা কাজে লাগিয়ে আমদানিকারকরা প্রচুর ছোলা আনেন।
আগামী ১ মার্চ থেকে রোজার মাস শুরু হতে পারে। এই সময়ে ইফতারের জন্য বিভিন্ন পদের খাবার তৈরিতে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের চাহিদা বছরের অন্য সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে বাড়ে ছোলার চাহিদাও।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এবং রাজধানীর লালবাগের পাইকারি বাজারেও কমেছে ছোলার দাম। মাস খানেক আগে পাইকারিতে প্রতি মণ ছোলার দাম ছিল ৪ হাজার ২০০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়। অর্থাৎ মণে কমেছে ৫০০ টাকা। কেজিতে ১২ টাকার বেশি। তার প্রভাবে খুচরা বাজারেরও ছোলার দাম কমেছে।
চট্টগ্রামের এবারে প্রচুর ছোলা আমদানি হয়েছে। বাজারে ছোলার কোনো সংকট নেই। সরবরাহও আগের চেয়ে বেড়েছে। নারায়নগঞ্জের নিতাইগঞ্জ, ঢাকার লালবাগের রহমতগঞ্জ থেকেও পাইকারি পর্যায়ে ছোলা বিক্রি হয়।
এ ব্যাপারে রহমতগঞ্জের ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দাম বাড়াই না। আমদানিকারকরা বেশি দামে বিক্রি করলে আমাদের বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হয়। কেজিতে সামান্য লাভ থাকে। এবারে রমজান উপলক্ষে প্রচুর ছোলা আমদানি হয়েছে। আগে বেশি দামে বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ৩ হাজার ৭০০ টাকা বস্তা (৪০ কেজি), ৯৫ টাকার মধ্যে ছোলা বিক্রি করা হচ্ছে।’
পাইকারিতে দাম কমায় খুচরা বাজারেও কমতে শুরু করেছে। নিউমার্কেটের সাথী এন্টারপ্রাইজের মো. মোক্তার হোসেন বলেন, ‘আগের চেয়ে ছোলার দাম কমেছে। এক মাস আগেও ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি করতাম। পাইকারিতে কমেছে। এ জন্য আমরাও কম দামে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করছি।’
মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের মনির স্টোরের আনোয়ার হোসেনও বলেন, ‘আগের চেয়ে ছোলার দাম কমেছে, ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। কম দামে কেনা। তাই কম দামেই বিক্রি করতে পারছি।’ কৃষি মার্কেটের মুদি বিক্রেতা নাইম শেখও জানান, আগের চেয়ে কমেছে ছোলার দাম। বর্তমানে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। সেটা আগে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি ছিল।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স একতা ট্রেডার্সের বিক্রয়কর্মী রায়হান বলেন, ‘এক মাস ধরে ধাপে ধাপে কমছে ছোলার দাম। বর্তমানে ১০০ টাকার মধ্যেই বিক্রি করা হচ্ছে।’ একই বাজারের খুচরা বিক্রেতা ফরিদগঞ্জ স্টোরের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গত রমজানের আগে কম দামে ৮০-৯০ টাকা কেজি ছোলা বিক্রি করেছি। রমজানে বেড়ে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়। রমজানের পর আরও বেড়ে যায়। তবে কয়েক দিন ধরে কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করছি।’
শুধু বড় বড় বাজারে নয়, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার দোকানেও কম দামে ছোলা বিক্রি করা হচ্ছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের জনতা মার্কেটের আক্তার হোসেনও বলেন, ‘মাস খানেক থেকে ছোলার দাম কমেছে। আগে ১২০ টাকার বেশি বিক্রি করা হলেও কয়েক দিন ধরে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করছি।’