
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আবারও প্যাকেজ ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছেন পুরোনো ঢাকার ব্যবসায়ীরা।
গতকাল রাজধানীর মীম কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত মতবিনিময়ে এ দাবি জানিয়েছেন তারা। পুরানো ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে এ সভার আয়োজন করা হয়। এতে বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
ব্যবসায়ীরা বলেন,অসহনীয় যানজট, জলাবদ্ধতা, অপ্রতুল অবকাঠামো, এসএমই খাতে অপর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ডলারের মূল্যের অস্থিরতা, উচ্চ সুদ হার ভ্যাট ও করের হার বৃদ্ধিসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। এতে করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের সহযোগিতা চান তারা।
উল্লেখ্য, ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ১৯৯১ সালের পুরোনো আইনে ‘প্যাকেজ ভ্যাট’ চালু ছিল। এ পদ্ধতিতে ছোট ব্যবসায়ীরা বছরে একসঙ্গে মোট বিক্রির ওপর থোক হিসেবে সরকারকে ভ্যাট দিত। নতুন ভ্যাট আইনে এটি বাতিল করা হয়। ছোট ব্যবসায়ীরা আবার পুরোনো ভ্যাট প্রথায় ফিরে যেতে চান।
উক্ত মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. সেলিম আল মামুন, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)-এর অতিরিক্ত কমিশনার মানস কুমার বর্মন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর উপ-পুলিশ কমিশনার (লালবাগ বিভাগ) মো. জসীম উদ্দিন বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা, কর ব্যবস্থার সহজীকরণ, আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা নিরসন, বাস্তবভিত্তিক ভ্যাট হার নিধারণের ওপর জোরারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘শতবছর ধরে পুরোনো ঢাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হলেও যানজট, অবকাঠামোর অপ্রতুলতা এবং কর ও ভ্যাটের প্রতিবন্ধকতার কারণে এখানকার উদ্যোক্তারা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যা নিরসনে সরকাররি-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একান্ত অপরিহার্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. সেলিম আল মামুন বলেন, ২০২২-২৪ পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে ডলারের মূল্য ৩৫ শতাংশ অবমূল্যায়িত হওয়ার কারণে ডলারের মূল্য অস্বাবাভিক হারে বেড়ে যায় এবং মুদ্রাব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ খাতে স্থিতিশীলতা আনয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি জানান, গত ৬ মাসে আমদানি ও রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ৩.৫ এবং ১০.৯ শতাংশ এবং গত ৭ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি আরও বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে টাস্কর্ফোস গঠন করেছে।
কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)-এর অতিরিক্ত কমিশনার মানস কুমার বর্মন বলেন, সরকার ভ্যাট ব্যবস্থা সহজীকরণের জন্য ভ্যাট অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা অটোমেটেড করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ফলে ব্যবসায়ীরা হয়রানি হতে মুক্ত হবেন। তিনি রশিদবিহীন ভ্যাটের টাকা না প্রদানের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ভ্যাট সবসময় নির্ধারিত হয়ে থাকে মূল্যসংযোজনের ওপর।
ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (লালবাগ বিভাগ) মো. জসীম উদ্দিন বলেন, পুরোনো ঢাকার যানজট নিরসনে ৮টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া আসন্ন রমজান মাসে নগদ টাকা পরিবহনে ব্যবসায়ীদের পুলিশের সহায়তা নেওয়ার প্রস্তাব করেন। যানজট নিরসনে পুরোনো ঢাকার বেশকিছু রাস্তা ওয়ানওয়ে করা হবে তিনি অভিহিত করেন। কিশোর গ্যাংকে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে এটি মোকবিলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইর প্রাক্তন পরিচালক মনোয়ার হোসেন করের হার কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন, সেই সঙ্গে করের হার যৌক্তিকীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডিসিসিআইর প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আলহাজ আব্দুস সালাম বলেন, অসহনীয় যানজটের কারণে ব্যবসায়ীদের বিক্রি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কর ও ভ্যাটের উচ্চ হার এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারণে আমরা ক্রমশ ক্ষতির মুখোমুখী হচ্ছি।
ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপত মতিউর রহমান বলেন, বর্তমানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এলসি মার্জিন কিছু ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হ্রাস করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও অর্থবছরের মাঝে এসআরও জারি করে শুল্কহার পরিবর্তন করলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে খাতভিত্তিক ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর প্যাকেজ ভ্যাট ব্যবস্থা চালু করা, ট্যাক্স-ভ্যাট ব্যবস্থাপর সহজীকরণ, যানজট নিরসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন বিশেষকরে কিশোর গ্যাং-এর উৎপাত নিয়ন্ত্রণ, আমদানি পর্যায়ে ট্যারিফ ভ্যালুর ওপর শুল্ক আরোপ, ভ্যাট হার হ্রাস, বন্ড লাইসেন্সের আওতায় আমদানিকৃত পণ্যের অপব্যবহার বন্ধ করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস এবং বন্দরের পণ্য খালাস প্রক্রিয়া অটোমেটেড ও সহজীকরণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. সালেম সোলায়মান, পরিচালনা পষদের সদস্যরা এবং প্রাক্তন সভাপতিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে ৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ডিসিসিআইর সদস্যপদ প্রদান করা হয় এবং ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির হাতে ডিসিসিআইর মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন।