
দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ কৃষি খাত। দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো কৃষির ওপর নির্ভর করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। এরপরও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান ধীরে ধীরে কমছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপিতে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। সেই হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জিডিপিতে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কৃষি খাতে ঋণ বিতরণও কমেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমার কারণেও জিডিপিতে কৃষির অবদান কমেছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বিবিএস এখন রাজনৈতিক চাপমুক্ত পরিবেশে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিতে পারছে। সে কারণে প্রবৃদ্ধি কম দেখা যাচ্ছে। আগে যখন সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক চাপে ছিল এবং দেশের অর্থনীতি বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন বিবিএসের প্রতিবেদন দেখে মনে হতো, দেশের অর্থনীতি তর তর করে কেবল বাড়ছে। সে বাস্তবতা এখন আর নেই। সে কারণে এখনকার কোনো তথ্য-উপাত্তই অতীতের সঙ্গে তুলনা করা যুক্তিসংগত নয়। তবে গত প্রান্তিকে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির ছিল। তাতে কম হারে প্রবৃদ্ধি হবে, সেটা খুব সহজেই অনুমেয় ছিল। সেই হিসেবে কৃষির প্রবৃদ্ধিও কমেছে। তার মানে এই নয় যে কৃষি উৎপাদন কমে গেছে। কৃষি উৎপাদন আগে যে হারে বেড়েছে সেই হার হয়তো কিছুটা কমে গেছে।
এই বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক রিসার্চার ড. আব্দুস সাত্তার মণ্ডল খবরের কাগজকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে যেখানে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমেছে সেখানে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে কৃষির প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশে কৃষি জমির পরিমাণ খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কৃষিজমিতে অকৃষি অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আমাদের মাছের উৎপাদন যে হারে বাড়ছিল সেখানেও একটা ঘাটতি হয়েছে। কারণ পানি দূষণ বাড়ার পাশাপাশি জলাভূমিগিুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাছের উৎপাদন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তবে কৃষির প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমলেও এখনই আশঙ্কার কোন কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রযুক্তিই বড় ভূমিকা রেখেছে। এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন তথা প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। কৃষক পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে খামারের জমি যে কমে আসছে এবং ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে এতে প্রযুক্তির ব্যবহার দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এই অবস্থাই যদি চলতে থাকে তাহলে আগামী দিনে কৃষি প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমবে। তাই কৃষিজমিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে জমির একত্রীকরণ করতে হবে। কৃষকদের নিজেদেরকেই এই একত্রীকরণের কাজটা করতে হবে।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমেছে। এর আগের বছরের একই প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে টানা তিন প্রান্তিক ধরেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। কৃষি, শিল্প ও সেবা- এই তিন খাতের উপাত্ত নিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মানে, কৃষি খাতে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ঋণ বিতরণ কমেছে: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যা অর্থবছরের প্রথম পাঁচ (জুলাই-নভেম্বর) মাসে ১৩ হাজার ৮১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এটি মোট বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৩৪ শতাংশ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (প্রথম পাঁচ মাস) বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে জুলাই মাসের প্রথম ভাগে জামালপুর, আগস্টের শেষে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং সেপ্টেম্বরের শেষে বন্যায় প্লাবিত হয় দেশের উত্তরাঞ্চল। ফলে কৃষকরা পুরোপুরি ফসল ফলাতে পারেননি। এতে ব্যাহত হয় কৃষি উৎপাদন ও বিপণন। বন্যার কারণে কমে গেছে কৃষি ঋণ বিতরণও।
বাজেটে বরাদ্দ বাড়েনি: এদিকে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিতে ভরসা বাড়লেও, বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ তেমন বাড়ানো হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ভর্তুকি ও প্রণোদনায়ও বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় কম। চলতি অর্থবছর কৃষি খাতে বরাদ্দ মাত্র ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটের কমপক্ষে ১০ শতাংশ কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা উচিত। কৃষি খাতসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় আগামী অর্থবছরের জন্য ৩৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ২ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা বেশি। শতাংশের হিসাবে মাত্র ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অথচ মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে গত দুই বছরে জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবা খাতসহ অন্যান্য খাতে ব্যাপক ধস নেমেছিল। এমন খারাপ সময়ের মধ্যেও কৃষি খাতই দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে পেরেছিল। কৃষকরা করোনাকে উপেক্ষা করে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করেছিলেন। এক সময় বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ ছিল। ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বর্তমানে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। এখন অনেকটাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে সরকারকে এই খাতে আরও বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।