
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, বাস্তবতার নিরীখে আমাদের নীতি-নির্ধারণ করা দরকার। যার বিনিময়ে আমরা খারাপ প্লাস্টিককে বাদ দেব এবং ভালো প্লাস্টিকের সঙ্গে বাসবাস করব। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আমাদের পরিবেশবান্ধব ভালো প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
গতকাল বুধবার ঢাকার বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি (আইসিসিবি)-তে চার দিনব্যাপী ১৭ তম ইন্টারন্যাশনাল প্লাস্টিক, প্যাকেজিং এবং প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
গতকাল থেকে রাজধানীতে চার দিন ব্যাপী এ মেলা শুরু হয়েছে। চলবে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা যে প্রিফারেনশিয়াল এক্সেস (অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা ) পাচ্ছি তা আর থাকবে না। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইনসেন্টিভও (প্রণোদনা) দিতে পারব না। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা ও পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগী সক্ষম হতে হবে। সক্ষমতা না থাকলে বিপদে পড়ে যাব।
উপদেষ্টা বলেন, প্লাস্টিকে ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। এটি পরিবেশের কি কি ক্ষতি করে সেটিও নতুন করে বলার কিছু নেই। এজন্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাট, কাগজের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এবং যেসব খাদ্য প্লাস্টিকের প্যাকেজিং ছাড়াই ব্যবহার করা যায় সেগুলো প্যাকেজিং ছাড়াই ব্যবহারের অভ্যাস করতে হবে।
তবে এ খাতের সম্ভবানকে সামনে এনে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, এই মেলায় প্লাস্টিক বিষয়ক যেসব আন্তর্জাতিক কোম্পানি এসেছে, এবং দেশীয় উদ্যোক্তার উপস্থিতি দেখতে পারছি, তাতে বলা যায়, এই সেক্টরটি খুবই সম্ভাবনাময়। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আর উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এ খাতের বিষয়ে আমাদের আরও ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স আ্যসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি কে এম ইকবাল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন এক্সপোর্ট কমপিটিটিভনেস ফর জবস প্রজেক্টের ডেপুটি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর শেখ মো. আবদুর রহমান, ইয়র্কর্স ট্রেড অ্যান্ড মার্কেটিং সার্ভিস কোম্পানি লিমিটেডের আকাই লিন, সার্ক চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। বাংলাদেশ প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স আ্যসোসিয়েশনের সভাপতি সামিম আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। পরে বাণিজ্য উপদেষ্টা মেলায় বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন ও হংকংভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইওর্কর্স ট্রেড অ্যান্ড মার্কেটিং সার্ভিস যৌথভাবে আয়োজন করছে এ মেলাটি। ইন্টারন্যাশনাল প্লাস্টিক ফেয়ারে ৮০০টিরও বেশি স্টল থাকছে, যেখানে ১৮টি দেশ থেকে ৩৯০টিরও বেশি ব্র্যান্ড অংশগ্রহণ করছে। চীন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, জাপান, ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য ও প্রযুক্তি প্রদর্শন করবে এই মেলায়। এটি দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে।
জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের প্লাস্টিকের যে সেক্টর সেটি খুবই সম্ভাবনাময়। আপনারা জানেন ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানের মানুষের মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কেজি। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি মাত্র ৯ থেকে ১০ কেজি। একটি দেশের উন্নয়ন সে দেশের প্লাস্টিকের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। কারণ প্লাস্টিক হচ্ছে এমন একটি শিল্প যা পেছন থেকে বড় বড় উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোকে সহযোগিতা করে।
তিনি বলেন, এ ছাড়া আমাদের গায়ে যে পোশাকটি আছে যা হাতে তৈরি হয় সেটি সিনথেটিকের। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে পাঁচটি প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে একটি গাছ কাটা বন্ধ করা যায়। আমরাও প্লাস্টিককে কীভাবে পরিবেশবান্ধব ভাবে ব্যবহার করতে পারি সেটি নিয়ে কাজ করছি। এখানে ৬ হাজার কারখানায় ১২ লাখের বেশি মানুষ কাজ করছে। ফলে সরকারের সরাসরি নীতি সহায়তা ছাড়া এ খাতকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না।
বিপিজিএমইএ সভাপতি বলেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য সব সময়ই সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর চাপ থাকে। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়ই প্লাস্টিক ব্যবহারের বাইরে না। তারা কোনো না কোনো কাজে প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। ফলে নিষিদ্ধ না করে কীভাবে এটিকে পরিবেশবান্ধব করা যায় সে বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাজার থেকে মুড়ি কিনছি, এটি প্যাকেজিং করা হচ্ছে প্লাস্টিকে। মিল্ক ভিটার দুধ, এর ওপরে প্লাস্টিক থাকে, ভেতরে কালো একটি পেপার থাকে, যাতে রেডিয়েশনের কারণে দুধ নষ্ট না হয়। লবণ প্যাকেজিং করা হয় প্লাস্টিকে। প্লাস্টিকের প্যাকেজিং ছাড়া লবণের আয়োডিনের গুণগত মান ঠিক রাখা যাবে না। ওষুধের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
সরকারের পক্ষ থেকে ১৭টি পণ্যের প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও আমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব বিষয়গুলোকে পুন বিবেচনা করার।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিশ্ব বাজারে টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেলস পণ্যের মতো বড় খাত হচ্ছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্যের। হিসাবে দেখা যায় যে, টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেলস সেক্টরের অবস্থান হচ্ছে ৭৭২ বিলিয়ন ইএস ডলার। এর মধ্যে শুধু অ্যাপারেলস সেক্টরের অবদান ৪০৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার।’
বর্তমানে রপ্তানিতে প্লাস্টিক পণ্যের অবস্থান ১২তম। কিন্তু প্রচ্ছন্ন রপ্তানি (যার মধ্যে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উল্লেখযোগ্য) হিসাব এর সঙ্গে যুক্ত হলে রপ্তানিতে প্লাস্টিক পণ্যের অবস্থান হবে ষষ্ঠ। বর্তমানে বাংলাদেশে উন্নতমানের খেলনা আইটেম তৈরি হচ্ছে। দেশে ইতোমধ্যে পি পি ওভেন খাতে ৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার ওপরে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১ লাখ মানুষের। প্লাস্টিক খেলনা আইটেম বিভিন্ন দেশে রপ্তানি শুরু হয়েছে। এ খাতের সম্ভাবনাও ব্যাপক। প্লাস্টিক পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশসহ সমগ্র ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন চীন, ভারত, নেপালসহ ১২৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ।