নতুন জামা-জুতার সঙ্গে ঈদ আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করে ঈদ সালামি। আর সেই সালামিটা হওয়া চাই নতুন নোটে। ঈদ উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে নতুন নোট ছাড়ে। চলতি বছরও সে রকমই প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিযুক্ত টাকা আর বাজারে ছাড়া যাবে না- এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে শেষ পর্যন্ত নতুন টাকা বিনিময়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন সিদ্ধান্তে গ্রাহকরা ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের ফুটপাত থেকে বেশি দাম দিয়ে নতুন টাকা কিনছেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কোন কোন শাখার মাধ্যমে নতুন নোট বিনিময় করা যাবে, তা জানিয়ে একটি সার্কুলার প্রকাশ করে। সার্কুলার অনুযায়ী, ঈদ উপলক্ষে গতকাল বুধবার থেকে আগামী ২৫ মার্চ মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন নোট বিতরণ করার কথা ছিল। রোজা শুরুর আগেই এসব শাখায় চাহিদা অনুযায়ী নতুন নোট পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে এসব ব্যাংক থেকে সমপরিমাণ টাকা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিযুক্ত নোট ছাড়া নিয়ে বিতর্কের মুখে গত ১০ মার্চ নোট বিতরণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তে ফুটপাতে জমে উঠেছে নতুন টাকার রমরমা ব্যবসা। সারা বছরই তারা এই ব্যবসা করলেও ঈদের আগে চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এক বান্ডিলে থাকে ১০০টি নোট। এবারে ১০ টাকার এক বান্ডিল নতুন নোট নিতে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য নোটের ক্ষেত্রেও আনুপাতিক হারে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। যেমন ২০ টাকার নোটে তারা অতিরিক্ত নিচ্ছে ৬০০ টাকা, ৫০ টাকার নোটে ৩০০, ১০০ টাকার নোটে ৫৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না ২ এবং ৫ টাকার নোটেও। ২ টাকার নোটে নিচ্ছে ১৫০ আর ৫ টাকার নোটে নিচ্ছে ২৫০ টাকা। ব্যাংকে না পাওয়ার কারণে এবার ফুটপাতের দোকানিরা দাম হাঁকছেন বেশি। গতবারও নতুন নোট চাহিদার তুলনায় কম ছাড়ায় ব্যবসায়ীরা প্রতি বান্ডিলে সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বেশি নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক তো এবার নতুন টাকা দিচ্ছে না। তাহলে বাইরে বিক্রির জন্য নতুন টাকা আপনারা কোথায় পেয়েছেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী বিক্রেতা বলেন, ‘যারা টাকা নিয়ে আসে, তাদের কাছ থেকেই আমরা কিনে নিচ্ছি। ব্যাংকের পিয়ন থেকে শুরু করে অনেকেই এ টাকা নিয়ে আসেন।’
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি টাকা দিয়ে আমাদের কিনতে হচ্ছে। ফলে আমাদের লাভ খুব বেশি থাকছে না। তিনি বলেন, ‘রোজার দিনে সারা দিন রোদে দাঁড়িয়ে থেকে আমরা প্রতি নোটে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ১০০ টাকা পাচ্ছি।’
নোট কিনতে আসা আরেফিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঈদে বাড়ি যাব। ছোট ভাইবোনদের সালামি হিসেবে প্রতিবছর নতুন টাকা দেই। তখন ওদের হাসিমুখ দেখতে খুব ভালো লাগে। এবার তো ব্যাংকে নতুন টাকা দিচ্ছে না। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে ১০ টাকার দুটি নোট নিয়েছি। এ জন্য অবশ্য আমাকে ৮০০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ছাড়াও রাজধানীর গুলিস্তান, সদরঘাট, মিরপুর, ফার্মগেট, রায়সাহেব বাজার এলাকায় নতুন নোটের পসরা বসিয়ে থাকেন নিয়মিত ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ফুটপাতে নতুন নোট কীভাবে আসে, সেই প্রশ্ন নতুন নয়। এর সঠিক উত্তর কখনো মেলেনি। এ প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এবার নতুন নোট বিতরণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাও নতুন নোট বিনিময় করতে পারছেন না। তারপরও কীভাবে নতুন নোটের কারবারিরা সেটি পাচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। এবার ব্যাংক থেকে নতুন টাকা নেওয়ার সুবিধা বন্ধ রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাজারে যে পরিমাণ নোট প্রচলিত রয়েছে, এতে যদি এখন আবার ফ্রেশ নোট বাজারে ছাড়া হয়, তাহলে বাজারে টাকার পরিমাণ বেড়ে যাবে। এ ছাড়া যেহেতু খুব শিগগিরই নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে ছাড়া হবে, তাই এখন আর বাজারে নতুন নোট না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
এদিকে, এবার নতুন নোট বিনিময় না করার সিদ্ধান্তের পর ব্যাংকগুলোতে সংকট তৈরি হয়েছে। ঢাকায় বিভিন্ন ব্যাংকের ৮০টি শাখার ভল্টে ৫, ২০ ও ৫০ টাকার নতুন নোটের বিশাল ভান্ডার থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না। আবার এসব নোট ফেরতও নিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে শাখার ভল্টের বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে নোটগুলো। আরেক দিকে প্রতিটি শাখার উল্লেখযোগ্য পরিমাণের টাকা আটকা পড়েছে। এ তালিকায় সংকটে থাকা ব্যাংকের ১৯টি শাখাও রয়েছে। ব্যাংকগুলোর জন্য এসব নতুন টাকা যেন এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, প্রতিটি শাখার ভল্টের ধারণক্ষমতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ একটি সীমা নির্ধারিত আছে। কোথাও ওই সীমার বেশি টাকা জমা হলে তা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সোনালী ব্যাংকের ‘চেস্ট’ শাখায় জমা দিতে হয়। প্রতিটি ব্যাংকে সাধারণত ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট থাকে বেশি। এতে জায়গা লাগে কম। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে বাজারে ছাড়ার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২, ৫, ১০, ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার নোট বাজারে ছাড়ার জন্য শাখাগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এতে ভল্টের পুরো জায়গা ভরে গেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তে সমস্যায় পড়েছে এ শাখাগুলো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন নোট ছাড়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছিল। শাখাগুলোতে নতুন নোট পাঠিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু সেসব টাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকায় তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকও নতুন নোট বাজারে ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। এতে নতুন টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলো সংকটে পড়ে যায়।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী করণীয় নির্ধারিত না হওয়ায় এখনই ফেরত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ভল্টে নোট পাঠানোর জন্য একটি খরচ আছে। আবার নোট ফেরত আনতেও খরচ আছে। যে কারণে কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে।’