
তিন দফা সময় বাড়ানোর পরও ব্যক্তিশ্রেণি আয়কর রিটার্ন জমা সেই ৪০ লাখের ঘরেই আটকে আছে। তবে গতবারের তুলনায় এবারে রিটার্ন জমা বেড়েছে। এবারে মোট করদাতা নিবন্ধনের ৬৪ শতাংশই রিটার্ন জমা দেননি। এনবিআর সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রতি করবর্ষে গড়ে ৩৫ লাখের মতো করদাতা রিটার্ন জমা দিলেও বাকিরা দেন না। এবার তা হবে না। রিটার্ন জমা না দিলে চলতি করবর্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, রিটার্নে তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিয়েও এবার পার পাওয়া যাবে না। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এখন করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা ইটিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। এর মধ্যে চলতি করবর্ষে রিটার্ন জমা পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ। অর্থাৎ মোট টিআইএনধারীর ৩৬ শতাংশ রিটার্ন জমা দিয়েছেন। বাকি ৬৪ শতাংশ দেননি। গত করবর্ষে রিটার্ন জমা দেওয়া হয়েছে ৩৬ লাখ। সে তুলনায় এবার রিটার্ন বেড়েছে ৪ লাখের মতো। তার আগের বছরে ছিল ৩০ লাখ রিটার্ন জমা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রিটার্ন জমা বাড়লেও করদাতার সংখ্যা অনুযায়ী তেমন বাড়ছে না।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের নির্দেশে প্রতিটি কর অঞ্চল থেকে যেসব করদাতা ইটিআইএন নেওয়ার পরও এখনো রিটার্ন জমা দেননি তাদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে রিটার্ন জমা দিতে বলা হচ্ছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ইটিআইএন থাকার পরও যারা দীর্ঘদিন ধরে রিটার্ন দাখিল করছেন না, তাদের এনবিআর থেকে শিগগির নোটিশ পাঠানো হবে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘যারা রিটার্ন দাখিল করছেন না, তাদের কোনো সমস্যায়ও পড়তে হচ্ছে না। তাই আমরা এ বিষয়ে এনফোর্সমেন্টে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার রিটার্ন মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জরিমানা করা হবে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকে ইটিআইএন গ্রহণ করার পর দুই-এক বছর রিটার্ন দিলেও কোনো কারণ ছাড়াই পরের করবর্ষে আর দেন না। অনেকে পাওনা করের চেয়ে অনেক কম দেন। অনেকে প্রয়োজনে টিআইএন নিয়ে থাকেন। কিন্তু একবারের জন্যও রিটার্ন দাখিল করেন না। এবার থেকে এসব চলবে না।’
এনবিআরের পরিসংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে ১ কোটি ১১ লাখ টিআইএনধারী। চলতি করবর্ষে সব মিলিয়ে ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫৭ জন করদাতা রিটার্ন দিয়েছেন। সরকারি কোষাগারে কর জমা হয়েছে ৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
তবে গতবারের চেয়ে এবার তিনগুণ বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছেন, ১৪ লাখ ৩১ হাজার ৩৫৪ জন। গতবার এ সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৮ হাজার ৯০১। এ বছর অনলাইনে রিটার্নকারীর কাছ থেকে কর পাওয়া গেছে ১৫৮ কোটি টাকা।
এনবিআরের তথ্যানুসারে, গত করবর্ষে ৩৬ লাখ ৬২ হাজার করদাতা রিটার্ন জমা দেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার পরিমাণ ছিল ৯৮ লাখ ৩৪ হাজার ৬১৫। সে হিসাবে প্রায় ৬৫ লাখ করদাতা রিটার্ন জমা দেননি।
আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, নিয়মিত সময়ের পরও রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে জরিমানা গুনতে হবে এবং অনেক ধরনের সুবিধা পাবে না।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যারা কর ফাঁকি দিতে রিটার্ন জমা দেননি বা তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিয়েছেন এনবিআর থেকে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারলে ভবিষ্যতে রিটার্ন জমা নেওয়ার প্রবণতা কমবে। এ বিষয়ে এনবিআরকে কঠোর থাকতে হবে।’
কোনো করদাতা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে অন্তত ছয় ধরনের সুবিধা পাবেন না। যার মধ্যে রয়েছে কর অব্যাহতির সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন না অর্থাৎ তার যেকোনো ধরনের কর অব্যাহতি প্রাপ্ত আয় করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া ওই করদাতা করমুক্ত আয়ের সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন না অর্থাৎ তার যেকোনো ধরনের করমুক্ত আয় করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচনা হবে। হ্রাসকৃত হারে কর প্রদানের সুবিধা প্রাপ্ত হবেন না। এ ছাড়া ওই ব্যক্তি কোনো ধরনের বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধা প্রাপ্ত হবেন না।
এ ছাড়া আয়কর আইন ২০২৩-এর ধারা ১৭৪ ও ২৬৬ অনুযায়ী তাকে অতিরিক্ত ও নির্ধারিত হারে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। আইন অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি সময়মতো আয়কর রিটার্ন দিতে ব্যর্থ হন, সে ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ অনুযায়ী ১ হাজার টাকা অথবা আগের বছরের করের ১০ শতাংশ জরিমানা করা যাবে। এ দুইটির ভেতরে যেটি পরিমাণে বেশি, সেই অঙ্কটি জরিমানা হতে পারে। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে যদি কেউ রিটার্ন দাখিল না করেন, তাহলে ওই জরিমানা ছাড়াও যতদিন ধরে তিনি রিটার্ন দেননি ওই পুরো সময়ের দিনপ্রতি ৫০ টাকা করে জরিমানা হতে পারে।
চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরেও সাধারণ করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাখা হয়। ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী ও প্রবীণ নাগরিকদের করমুক্ত আয়সীমা হবে ৪ লাখ টাকা, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং যুদ্ধাহত গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৫ লাখ টাকা আছে। এ ছাড়া, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশু বা দত্তক নেওয়া সন্তানের বাবা-মা বা আইনি অভিভাবকদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা সন্তান প্রতি ৫০ হাজার টাকা করে বাড়বে।
বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক করবর্ষে একজন ব্যক্তির আয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলেই তাকে কর পরিশোধ করতে হবে। হিসাব কষে দেখা যায়, এক মাসে নিট আয় ২৯ হাজার ১৬৭ টাকার বেশি হলেই কর দিতে হবে। আয়কর হার ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত, পরবর্তী ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকার ওপর ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট টাকার ওপর ৩০ শতাংশ।