
ব্যাংকিং খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারেনি। ফলে বিদায়ী বছর শেষে এই ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে চার গুণ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। আর আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে এ ঘাটতি বেড়েছে ৫১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে গত দেড় দশকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই এখন আর ফেরত আসছে না। এর প্রভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।
খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বাড়বে। আর এ সময়ে যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
এই প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ দিন দিন বাড়ছে। এসব ঋণে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। দেশে আর্থিক সংকট থাকার কারণে বর্তমানে আমানতের প্রবৃদ্ধি তেমন একটা নেই। পাশাপাশি এতদিন ব্যাংকে বড় রকমের তারল্য সংকটও ছিল। এই কারণে হয়তো ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না।
একই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশনের পরিমাণ বাড়ে। এটা যদি মুনাফা থেকে মেটানো না যায়, তাহলে মূলধনের ওপর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ মূলধন কমে যায়। তখন ব্যাংকের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো ডিভিডেন্ড দিতে পারে না। ফলে বাজারে শেয়ারের দাম কমে যায়।
নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ দেয় তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সে জন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রাখা হয়েছে। ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্ন বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
অন্যান্য বছর কোন ব্যাংকে কত ঘাটতি সেই তথ্য প্রকাশ করা হলেও এই বছর ব্যাংকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বছরের পর বছর প্রভিশন ঘাটতিতেই থাকে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এ সময় তাদের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৭৪ হাজার ২১৭ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তারা সংরক্ষণ করেছে মাত্র ১৬ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। কিন্তু এই খাতের ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করেছে মাত্র ৮৭ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। ফলে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা।
তবে এ সময় আশার আলো দেখা যাচ্ছে বিদেশি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে। এই দুই খাতের ব্যাংকগুলোতে কোনো প্রভিশন ঘাটতি নেই। বরং এসব ব্যাংক উদ্বৃত্ত প্রভিশন রেখেছে। এ সময় বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষনের কথা থাকলেও তারা সংরক্ষণ করেছে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। ফলে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪৬৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত প্রভিশন রেখেছে। একইভাবে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার প্রভিশন রাখার দরকার ছিল, যার বিপরীতে তারা ৩ হাজার ৮৩ কোটি টাকা প্রভিশন রেখেছে। ফলে এই খাতের ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত প্রভিশনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে ব্যাংকগুলোর মোট প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করেছে মাত্র ১ লাখ ৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
কেবল প্রভিশন ঘাটতিই নয়, খেলাপি ঋণের আকারও ভয়াবহভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময় মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩২ কোটি টাকা। আর আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। এর আগের তিন মাসে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এর মানে গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। তথ্যে আরও দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এই হার আগের প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে কিছুটা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।