
রমজানে দেশি লাল চিনির চাহিদা বাড়ে। তবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন তা সরবরাহ করতে পারছে না। এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতিমুনাফার লোভে রং মিশিয়ে কথিত লাল চিনি বিক্রি করছে ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি। রমজান মাসে ভোক্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এই লাল চিনি কিনতে।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ‘নকল ও ভেজাল চিনি বিক্রির জন্য উৎপাদকদের ধরার ব্যবস্থা করুক ভোক্তা অধিদপ্তর।’ বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) বলছে, অতিমুনাফাখোররা একেক সময়ে একেক রকম রূপ ধারণ করছে। কখনো প্যাকেট হুবহু নকল করে, আবার কখনো বাংলাদেশ আখ শিল্প করপোরেশনসহ বিভিন্ন নামে বাজারে এই চিনি ছাড়ছে। স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ চিনি।
এ ব্যাপারে বিএসএফআইসির বিপণন প্রধান ও মুখপাত্র মো. আকুল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ আখ শিল্প করপোরেশন লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের নেই। অস্তিত্ববিহীন এই কোম্পানি লাল চিনি বিক্রি করতে পারে না।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মো. আকুল হোসেন বলেন, ‘১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৯টি উৎপাদনে আছে। আগে কম উৎপাদন হলেও চলতি মৌসুমে ৪০ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। দেশের মীনা বাজার, স্বপ্ন, আগোরা, আরএফএল বেস্টবাই সুপারশপে প্যাকেটজাত চিনি ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সারা দেশে ডিলারের মাধ্যমে (৫০ কেজি) বস্তার চিনি ১২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।’
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও তদন্ত) মাজহার উল হক খান বলেন, ‘দেশে লাল চিনি একমাত্র আমাদের চিনিকলের মাধ্যমে উৎপাদন। আমরা ছাড়া অন্য কারও বিক্রি করার অধিকার নেই। কাজেই কারা, কোথায়, রং মিশিয়ে লাল চিনি প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে তা ধরার জন্য ভোক্তা অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে চিনি দেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের কাছেও খবর এসেছে হুবহু প্যাকেট নকল করে বেশি দামে চিনি বিক্রি করছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। আইনে আমাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। বাজারে অভিযানও করতে পারছি না। এর আগেও বিভিন্ন কোম্পানি রং মিশিয়ে লাল চিনি বিক্রি করায় ভোক্তা অধিদপ্তর তাদের জরিমানা করেছে। এদের মধ্যে মাইশা নামেও একটি কোম্পানি রয়েছে।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর মতে, সারা দেশে বছরে চিনি লাগে ২০ লাখ টন। প্রতি মাসে গড়ে দেড় লাখ টন লাগে। রমজানে চাহিদা দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩ লাখ টনে পৌঁছে। রিফাইন করা বিভিন্ন কোম্পানির সাদা চিনি ১২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের লাল চিনি ১৪০ টাকা কেজি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে রং, মিশিয়ে লাল চিনিতে ভরে গেছে বিভিন্ন বাজার। কেউ সরকারের লাল চিনির মোড়কজাতের মতো করে ১৪০ টাকা কেজি, কেউ বা ১৭০ টাকা দরে বিক্রি করছে। কারওয়ান বাজারের হাজী মিজানুর স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. মিজানুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘লাল চিনি আছে, ১৪০ টাকা কেজি।’ কিন্তু এটাতো সরকারি না? এমন প্রশ্নের জবাবে মেসার্স রাহা এন্টারপ্রাইজের মেমো দেখিয়ে বলেন, ‘আমাদের যারা এই চিনি দিয়েছে কিছু বলার থাকলে তাদের বলেন। তারা দেশি লাল চিনি বলে ১৩৮ টাকা কেজি রেট ধরেছে।’
তার কথার সত্যতা যাচাই করতে কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় মেসার্স রাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. মো. জুয়েল হোসেনের কাছে গেলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি যে লাল চিনি বিক্রি করছি, সেটা চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের; যার এমআরপি ১৪০ টাকা। বাজারে অনেকে রং মেশানো লাল চিনি বিক্রি করলেও আমি করি না। কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার মেমো ব্যবহার করে এভাবে অস্তিত্ববিহীন বাংলাদেশ আখ শিল্প করপোরেশনের নামে চিনি বিক্রি করছে।’
একই মার্কেটের ২৩৪ নম্বর দোকান মেসার্স পলাশ এন্টারপ্রাইজের জসিম উদ্দিন বলেন, ‘খোলা লাল চিনি ১৪৫ টাকা কেজি।’ একটু দূরে মেসার্স মাজেদা স্টোরের বিক্রয়কর্মী নুরে আলম বলেন, ‘লাল চিনি আছে- ১৭০ টাকা কেজি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘এটা রং মেশানো লাল চিনি। অরিজিনালটা পাওয়া যায় না।’ মেমো দেখতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা (সরবরাহকারী) মেমো দেয় না। বেশি লাভ করার জন্যই তারা এ কাজ করছে। তাদের ধরে শাস্তি দেওয়া হোক এটা আমরাও চাই।’
এ সময় টুটুল মিয়া নামে এক ভোক্তা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের দুর্বলতার কারণেই তারা এভাবে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। চাহিদা মতো দিতে না পারায় ভেজালকারীরা রং মিশিয়ে লাল চিনির নামে প্রতারণা করছে।’ শুধু এ বাজারেই নয়, টাউন হল বাজারসহ অন্য বাজারেও দেখা গেছে একই চিত্র। এভাবে বেশি দামে কথিত লাল চিনি বিক্রি করলেও অধিকাংশ বিক্রেতা দোকানের মেমো দেখাতে পারেননি। রমজান মাস কেন্দ্র করে বাজারে ভরে গেছে কথিত লাল চিনিতে।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ মোহাম্মদ আলীম আখতার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘চিনির দাম বাড়ার কারণে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কিছু লোকের যোগসাজশেই প্যাকেট হুবহু নকল করা হচ্ছে। না হলে প্যাকেটের চারিদিকে এত সেফটি দেওয়ার পরও কীভাবে নকল হয়। যেহেতু স্বাস্থ্যগত ব্যাপার জড়িত, তাই এ ইস্যুতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষেরও উচিত হস্তক্ষেপ করা’