প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এবারের সফরে কাতারের জ্বালানিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সাদ বিন শেরিদা আল কাবির সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে আরও বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এ ছাড়া সে দেশের সরকারি নীতিনির্ধারক এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার কী কী সুবিধা বাড়িয়েছে, তাও জানানো হয়েছে। কাতার থেকে বাংলাদেশে জ্বালানিসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়ার বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ও কাতারের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী শেখ ফয়সাল বিন আল থানির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও বিনিয়োগ বাড়াতে আলোচনা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এবারের সফরে বাংলাদেশ কাতারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ কাতারের বিনিয়োগ বাড়ানো নিয়ে কথা হয়েছে। এসব বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত সোমবার চার দিনের সফরে কাতার সফরে গেছেন। সফরকালে আর্থনা (আমাদের পৃথিবী) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়াসহ কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে দুই দেশের বাণিজ্য বাড়াতে আলোচনা হয়েছে।
এসব বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে কাতারে জনশক্তি রপ্তানি, কাতার থেকে এলএনজি আমদানি, ব্যবস্যা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা হয়েছে।
এর আগে গত বছর ২৩ এপ্রিল ঢাকা সফরে এসেছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি। সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাতারের আমির বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়। এবার প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরে সেসব চুক্তি ও সমঝোতার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা আছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকীন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর অনেক সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগ আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যাগে কাজ করতে হবে। আমাদের বোঝাতে হবে যে, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান।
এবারের সফরে এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত বাণিজ্যবিষয়ক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও কাতারের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সেবা এবং অন্যান্য শিল্প খাতে বাণিজ্য কার্যক্রম আরও জোরদার করা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বাণিজ্য বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং পরিষেবা-সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় বাড়াতে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি দুই দেশের ব্যবসায়িক তথ্যের আদান-প্রদান, বাণিজ্য বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেওয়া, প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার বিষয়ও বৈঠকে স্থান পেয়েছে। বৈঠকে বাণিজ্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশের সংশ্লিষ্টদের সাব-কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠনের বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার সফরসঙ্গীদের সঙ্গে কাতার সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন বৈঠকে সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে শিল্প-বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. আবুল বাশার মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, সরকার থেকে আগে নির্ধারণ করতে হবে যে কোন খাতে কাতার থেকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের সুফল বেশি পাওয়া যাবে। কাতার থেকে জ্বালানি ও আইটি খাতে বিনিয়োগ আনা যেতে পারে। এ জন্য সরকারকে ওই দেশের সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
শুধু বেসরকারি বিনিয়োগ নয়, প্রধান উদেষ্টার এবারের সফরে বাংলাদেশে কাতার সরকার ও ওই দেশের বেসরকারি খাতের যৌথ বিনিয়োগেরও আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিলের (জেবিসি) নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাণিজ্য জোরদার করতে বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়কার অনেক সমস্যা এখন আর নেই। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিতে। এসব সুবিধা কাতারের ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে। তা হলে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে আমি মনে করি।’
প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফর উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় প্রণীত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের সফর দুই দেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন হবে। কাতারের ব্যবসায়ীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পক্ষেও কাতারের রপ্তানি বাজার ধরা সহজ হবে। কাতার থেকে জ্বালানিসহ শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি বাড়ানো হলে দুই দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে উভয় দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে বৈঠক ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগ আকর্ষণের বিপুল সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ ও কাতারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য মূলত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), সার বা পেট্রোকেমিক্যাল পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। এই পণ্যগুলো বাংলাদেশ কাতার থেকে আমদানি করে থাকে। প্রতি অর্থবছরে গড়ে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমদানির পরিমাণ এর কয়ক গুণ বেশি, গড়ে ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলার। কাতারের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে মূলত দেশের বাইরে তাদের যে বিনিয়োগ রয়েছে তার দক্ষতার ওপর। কীভাবে কাতারের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনা যায়, সেদিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে।
সূত্র জানায়, এবারের সফরে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে কর পরিহার, বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা এবং যৌথ ব্যবসা বাড়ানোয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে কাতারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক হবে বলেও খবরের কাগজকে জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কাতার থেকে জ্বালানি, সার বা পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য আমদানি বাড়াতে হবে। আমদানির তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ কম। কাতারের নির্মাণ খাতসহ আরও বেশ কিছু সেবা খাতে বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে। দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। কাতারে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ কম থাকলেও সে দেশের বিনিয়োগ নিয়ে আসার সম্ভাবনা অনেক। সেখানকার উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। বাংলাদেশের জ্বালানি ও ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা বেশি। বাংলাদেশের বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আসতে পারে। কাতার যদি বাংলাদেশি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সে দেশে ব্যবসা করার প্রক্রিয়া সহজ করে, তবে কাতারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা ওভারসিজ অফিস স্থাপনের মাধ্যমে সেখানে সহজে পোশাক রপ্তানি বাড়তে পারে। কাতারে একই রকম সুবিধা পেলে সেখানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়বে।