
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে অর্থাৎ গত আগস্ট থেকে দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে, আর কমেছে ভারতে। যদিও জুলাই পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন ভারতেই সবচেয়ে বেশি হতো। সেই সঙ্গে গত জানুয়ারি মাসে দেশের ভেতরে ও বাইরে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন কিছুটা কম হয়েছে। তবে দেশের ভেতরে বিদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে। দেশে-বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর ডিসেম্বরে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন সবচেয়ে বেশি হয়। কারণ এ সময় স্কুল বন্ধ থাকে। ফলে অনেকে পরিবারসহ ভ্রমণ করতে বা চিকিৎসা করাতে বিদেশে যান। আর জানুয়ারি হচ্ছে বছরের প্রথম মাস। এ সময় বাচ্চাদের স্কুল শুরু হয়। তখন বিশেষ প্রয়োজন থাকলেও কেউ দেশের বাইরে যেতে পারে না। আবার এ সময় বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি, বই জামা, জুতা সহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে হয় তাই এ সময় চাইলেও কেউ ক্রেডিট কার্ডে বেশি লেনদেন করতে পারেন না। এসব কারণেই জানুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন কিছুটা কম হয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে তা আবার বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ দেশের ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী ৪৪টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তর ও বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং দেশের ভেতরে বিদেশি নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে দেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডে খরচ করেছেন ৩ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। যা আগের মাস ডিসেম্বরে ছিল ৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে দেশের ভেতরে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন কমেছে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ।
একইভাবে জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডধারীরা বিদেশে খরচ করেছেন ৪৪৫ কোটি টাকা। যা ডিসেম্বরে ছিল ৪৯১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে খরচ কমেছে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর মাসে বিদেশে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ওই মাসে দেশটিতে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে খরচ করা হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। মোট খরচের ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশই এখানে খরচ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে থাইল্যান্ড। এখানে খরচ করেছেন ৬৪ কোটি টাকা। যা মোট খরচের ১৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। সেখানে ব্যয় করেছেন ৩৮ কোটি টাকা। আর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া। সেখানে খরচ করেছেন ৩৫ কোটি টাকা। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। সেখানে ব্যয় করা হয়েছে ৩৩ কোটি টাকা। ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ভারত। সেখানে ব্যয় করা হয়েছে ৩২ কোটি টাকা।
যা আগের মাসেও চতুর্থ অবস্থানে ছিল। তখন সেখানে ব্যয় করা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভারতে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। গত জুলাইয়ের পর থেকেই ভারতে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমতে থাকে।
গত কয়েক মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাধারণত দেশের বাইরে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেন ভারতে; কিন্তু গত জুলাই মাসে তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে জুলাইয়ে দেশটি ভিসা কার্যক্রম সীমিত করে ফেলে। এর ফলে জুলাইয়ে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশিরা ভারত যেতে পারেননি। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ কারণেই দেশটিতে ক্রেডিট কার্ডে বাংলাদেশিদের খরচ কমেছে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেন ডিপার্টমেন্ট স্টোরে। জানুয়ারিতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে খরচের পরিমাণ ছিল ১৩২ কোটি টাকা। বিদেশের মাটিতে ক্রেডিট কার্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহার ছিল রিটেইল আউটলেট সার্ভিসে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে জানুয়ারিতে বাংলাদেশিরা খরচ করেছেন ৭৪ কোটি টাকা।
দেশে-বিদেশে জানুয়ারিতে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমলেও দেশে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ডে খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশিরা গত জানুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডে খরচ করেছেন ২৫৩ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল ২৪১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে বাংলাদেশে বিদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে ১২ কোটি টাকার। জানুয়ারিতে এ দেশে অবস্থানকারী যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়েছে, যার পরিমাণ ৬৭ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে ছিল যুক্তরাজ্য, দেশটির ক্রেডিট কার্ডে খরচ হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও এখন অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন। এখন আর কেউ ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল জমা দেয় না বা নগদ টাকা দিয়ে কেনাকাটার পরিমাণও অনেক কমে গেছে। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ কার্ড কিংবা অ্যাপ ব্যবহার করে কেনাকাটার বিল, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করছেন।
লেনদেন বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী দিনে এই লেনদেন আরও বাড়বে। কেননা কার্ড লেনদেনে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলো ছাড়সহ নানা অফার দিচ্ছে। ‘ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে কেনাকাটার বিল পরিশোধে মিলছে ছাড়। অনেক ব্যাংকের কার্ডের ধরনভেদে ফ্রিতে বিভিন্ন বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগও রয়েছে।’