সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুটি শর্ত নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি এখনো। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং অন্যটি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা। এই দুটি ইস্যুতে আইএমএফ যা চেয়েছে তা পূরণ করতে পারেনি সরকার। ফলে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির টাকা ছাড়ের বিষয়টি আপাতত ঝুলে গেছে। তবে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। আলোচনা অব্যাহত থাকবে। চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড় হবে কি না, তা জানা যাবে আগামী জুনের শেষে আইএমএফের বোর্ডসভায় চূড়ান্ত আলোচনার পর।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় আইএমএফের প্রতিনিধিদল।
চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাকি দুই কিস্তির অর্থছাড়ের আগে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নানা দিক পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি মিশন গত ৫ এপ্রিল ঢাকা আসে। এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার পর গতকাল তাদের সফর শেষ হয়। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতি পাঠ করেন তিনি।
ঋণের চতুর্থ কিস্তির টাকা পাওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর এটি পিছিয়ে নেওয়া হয় মার্চে। তখন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন এপ্রিলে মিশন আসার পর সরকারের সঙ্গে আলোচনা হবে। আমরা আশা করছি, ঋণের দুই কিস্তি (চতুর্থ ও পঞ্চম) এক সঙ্গে পাব। কিন্তু গতকালের সংবাদ সম্মেলনে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘২১ এপ্রিল থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে বসন্তকালীন সভা শুরু হচ্ছে। সেখানে ঋণের বাকি দুই কিস্তি নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় খুবই কম। এটি জিডিপির মাত্র ৮ শতাংশের নিচে। অথচ অনেক উন্নয়নশীল দেশে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ১২ শতাংশ। কাজেই, বাংলাদেশকে রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপরি বাজারভিত্তিক করা উচিত। বাজারভিত্তিক করার এখনি সময়। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশে রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থানে রয়েছে। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহও ভালো। কাজেই এখন বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে বিনিময় হার এখনি পুরোপুরি বাজারের ওপর দেওয়া ঠিক হবে না।’
উল্লেখ্য, এই দুটি শর্ত ছাড়া বাকি শর্তগুলো পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমান সরকার রাজস্ব আদায়ে কর সংস্কার, বিনিময় হারে নমনীয়তা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন ও ব্যাংক খাত সংস্কারে জোর দিয়েছে। তবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিষয়ে আরও জোর দিতে হবে। কর অব্যাহতি বাতিল করতে হবে। যোগ্য সবাইকে করের আওতায় আনতে হবে। রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে আইএমএফ এনবিআরের করনীতি ও কর প্রশাসন আলাদা করার উদ্যোগের প্রশংসা করেছে।
আইএমএফের সঙ্গে চলমান ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে পাওয়া গেছে ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে মোট ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। কর্মসূচিটির আওতায় এখন বাকি আছে ২৩৯ কোটি ডলার।
মিশনপ্রধান পাপাজর্জিও বলেন, ‘স্বচ্ছতা, সুশাসন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’ ব্যাংক খাতে সুসংগঠিত সংস্কার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সুশাসন ও স্বচ্ছতা বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নে ও রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্য আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ জলবায়ু-সহনশীল অর্থনীতিতেও বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫.১ শতাংশ। এর কারণ হলো, গণ-অভ্যুত্থান এবং বিনিয়োগের ওপর অনিশ্চয়তার প্রভাব। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১.৭ শতাংশে পৌঁছানোর পর, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে তা কমে ৯.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ৫-৬ শতাংশের চেয়ে এখনো অনেক বেশি।
অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আইএমএফ। বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় করের পরিমাণ অত্যন্ত কম। এটি বাড়াতে হলে একটি ন্যায়সংগত কর কাঠামো গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে এই উন্নয়ন সহযোগী।