ভ্যাটযোগ্য সব প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতায় নিবন্ধন নিতে হবে। যোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন না নিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইতোমধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সব কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে কঠোর বার্তা দিয়ে ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ১ মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে অথাৎ আগামী আট মাসে নতুন নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ১০ লাখ প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় আনতে বলা হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যানের পাঠানো নির্দেশে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের মধ্যে প্রতিটি কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট থেকে ভ্যাটযোগ্য সব প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরিপের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও করতে হবে। বিশেষ করে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান খবরের কাগজকে বলেন, দেশে ভ্যাটযোগ্য অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো এনবিআরে নিবন্ধিত হয়নি। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান ঠিকই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে থাকে। ভ্যাট আদায় করেও জমা না দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে এনবিআর কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ভ্যাটযোগ্য শতভাগ প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ভ্যাট আদায় করেও সঠিক হিসাবে পরিশোধ না করলে চলমান রাজস্ব আইনে মামলা করা হবে। ভ্যাটযোগ্য হয়েও অনলাইনে নিবন্ধন না নিলেও ভ্যাট ফাঁকির দায়ে মামলা করা হবে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ভ্যাট প্রদানে সক্ষম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হিসাব কষে কড়ায় গণ্ডায় ভ্যাট আদায় করে থাকে। অথচ এনবিআরে অনলাইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। বাকিরা আদায় করেও ভ্যাট জমা দেয় না। আর যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেবে তাদের বেশির ভাগই হিসাবমতো ভ্যাট পরিশোধ করে না।
এনবিআরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টের ধাক্কা সামলে এনবিআর অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনে জোর দিয়েছে। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে চলতি বছরের গত আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, (৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ) হয়েছে। আগস্ট মাসেও এ হার নেতিবাচক ছিল, ২৫ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত এনবিআরের সাময়িক হিসাবেও ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আছে। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী ভ্যাটের আওতা বাড়ানো এবং নতুন নতুন ভ্যাট দাতাকে ভ্যাট নেটে অন্তর্ভুক্ত করতে এনবিআর চেয়ারম্যান নানা ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বর্তমান সরকার দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর জন্য নতুন ভ্যাট নেট বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এনবিআরের নতুন প্রশাসন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নতুন ভ্যাটদাতা শনাক্তকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ভ্যাট নিবন্ধন বাড়াতে এনবিআর ইতোমধ্যে ভ্যাটযোগ্য বার্ষিক টার্নওভার সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ভ্যাটমুক্ত ও ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের আওতায় রাখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মাঠপর্যায়ের সব কমিশনারকে নতুন নিবন্ধন প্রদান ও আইনানুগ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতাদের সঙ্গে সেবামূলক মনোবৃত্তি বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সব কর্মকর্তাকে নতুন ভ্যাটদাতা বাড়ানো জন্য কাজ করতে বলা হয়েছে। কর্মকর্তাদের কর্মপ্রবণতা, দক্ষতা ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিবন্ধন সংখ্যা প্রবৃদ্ধিতে সফল কর্মকর্তাকে ‘বিশেষ স্বীকৃতি’ দেওয়া হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাট নেট বাড়াতে এনবিআরে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে পরবর্তী আট মাসে নতুন
নিবন্ধন সংখ্যা ৫০ শতাংশে উন্নীত করার প্রত্যাশা এনবিআরের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি অর্থবছরে গড়ে বড় ১১০ প্রতিষ্ঠান থেকে মোট আদায় করা ভ্যাটের ৪৯ শতাংশই আদায় হয়। বড় ১১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিগারেট, ঠিকাদার, নির্মাণপ্রতিষ্ঠান, তেল-গ্যাস কোম্পানি ও মোবাইল ফোন কোম্পানি রয়েছে। প্রতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে তা পূরণে এনবিআরকে চাপ দেওয়া হলে ভ্যাটের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানে ওপরই চাপ বাড়ানো হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বড় ১১০ প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি ভ্যাট আহরণ হয়।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাটের আওতায় বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট আদায়েও স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার শুল্ক-কর ফাঁকি উদঘাটন করেছে এনবিআর। এ ছাড়া ছোট-বড় সব ধরনের করদাতার কর ফাঁকির তদন্ত কাজও করছে সংস্থাটি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান খবরের কাগজকে বলেন, ভ্যাটের আওতা বাড়াতে এনবিআর সক্ষম হলে ভ্যাট আদায় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। বহুদিন থেকে এনবিআর ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর কথা বললেও সফল হতে পারছে না।
এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ছাত্র-জনতা আন্দোলনের এই মাস (ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফাঁকির তথ্য পেয়েছে ভ্যাট খাতে। এই খাতে সব মিলিয়ে ২৫০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য মিলেছে। এ জন্য ১৫৭টি ভ্যাট ফাঁকির মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব মামলার বিপরীতে ১০৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপের ভ্যাট ফাঁকির তদন্তে নেমেছে এনবিআর। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকের ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাট পরিশোধের পর তা যথাযথভাবে সরকারি কোষাগারে জমা না দিলেও ভোক্তারা অভিযোগ জানাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে জিআরএস (গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম বা অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা) পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যা একজন ভোক্তা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ থেকে অভিযোগ জানাতে পারবে। এ ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী সঠিকভাবে ভ্যাট পরিশোধ করতে এলেও কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দ্বারা হয়রানির শিকার হলে এনবিআর কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারবেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, জিআরএস পদ্ধতির মাধ্যমে ভোক্তা বা ব্যবসায়ী যে কেউ অভিযোগ জানাতে পারবেন। আশা করি এতে স্বচ্ছভাবে ভ্যাট আদায় সম্ভব হবে।