
ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমলেও কৃষিঋণে খেলাপি ঋণের হার খুব কম। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে কৃষিঋণে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। জানুয়ারি শেষে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা বকেয়া ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মাত্র ৪ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এই তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। আগের বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩২ কোটি টাকা। এই পরিমাণ খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই আটকে আছে বড় বড় কিছু শিল্পগ্রুপের কাছে। যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকরা কখনো ঋণ জালিয়াতি করেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে মাঝে মাঝে সমস্যায় পড়েন তারা। কিন্তু দেশের বৃহৎ শিল্পগ্রুপের মতো ঋণখেলাপির প্রবণতা তাদের মধ্যে একেবারেই নেই। তবুও কৃষকদের ঋণ বিতরণে এবং স্বল্প অর্থের ঋণ আদায়ে বেশি তৎপর ব্যাংকগুলো। যদিও ব্যাংকগুলোর উচিত বড় বড় শিল্পগ্রুপকে কম ঋণ দিয়ে কৃষি এবং এসএমই খাতে বেশি ঋণ বিতরণ করা।
এই প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় ঋণের চেয়ে কৃষিঋণে তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ অনেক বেশি। সে কারণেই ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ বিতরণে অনীহা দেখায়। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উপজেলা পর্যায়ে শাখাও নেই। আবার সরকারি ব্যাংকগুলোর অনেক শাখা বিস্তৃত থাকলেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে জর্জড়িত হওয়ার কারণে তারাও প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারছে না। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে কীভাবে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করা যায়, সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
একই বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী খবরের কাগজকে বলেন, ব্যাংকগুলোর হাতে এখন পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। যা এতদিন ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে আসছিল। বর্তমানে ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার কমায় ব্যাংকগুলো এখন বেসরকারি খাতে বিশেষ করে কৃষি এবং এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়াবে। কারণ সেখানে সুদহার বেশি। তাছাড়া এসব ঋণে খেলাপির পরিমাণও কম। তার পরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক নির্ধারিত হারে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করছে না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামীতে নিশ্চয়ই ব্যাংকগুলো তাদের নির্ধারিত হারে কৃষিঋণ বিতরণ করবে। কারণ কৃষকরা চেষ্টা করে সবসময়ই ঋণ ফেরত দিতে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়লে কেবল তারা সমস্যায় পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে সবসময়ই তাগিদ দিয়ে থাকে। বছরের শুরুতেই তাদের একটা লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়। এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করারও বিধান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ৩৮ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) ব্যাংকগুলো ১৯ হাজার ২১৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৫০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ সময় ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা কৃষি ও পল্লীঋণের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৮ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলো ৭৮৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এ সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১০ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। আর জানুয়ারি শেষে এই খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা।
জানা গেছে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋণের অন্তত ২ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষিঋণ বিতরণ করবে না, তাদের জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার অর্থ বিতরণে ব্যর্থ হবে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট তহবিলে ওই অর্থ জমা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এর ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে কৃষিঋণ বিতরণ। বছরের শুরুতে লক্ষ্যও ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে ১২ মাসেই বিশেষ করে ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা সময় মতো ঋণ পান।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচিত ৭ মাসে ২০ শতাংশের কম ঋণ বিতরণ করেছে মোট ১৪টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে ১০ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে শরিয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ বিতরণ করেছে আইএফআইসি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ, শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৭ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক বিতরণ করেছে ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়া সিটিজেনস ব্যাংক ২০ শতাংশ এবং ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসের সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মোট ৪ হাজার ৯১২ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি এক হাজার ৯৬২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এ ছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৪১৪ কোটি, সোনালী ব্যাংক ৮৮৩ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ৬৫১ কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৬১৭ কোটি এবং পূবালী ব্যাংক বিতরণ করেছে ৬০৭ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৪৫ কোটি টাকার কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণ করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।