
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যা গত জানুয়ারি থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। এতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহারও আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সুদহার বাড়ানোর পরও সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়েনি। বরং এ সময় নতুন সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতাই বেশি দেখা গেছে। জানুয়ারিতে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ঋণাত্মক ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময় নতুন বিক্রির চেয়ে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র থেকে এই পরিমাণ ভাঙ্গানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
এর আগে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও অক্টোবর মাস থেকে ভাটা পড়েছে। যা জানুয়ারিতেও অব্যাহত ছিল। এ সময় সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে নগদায়ন বেশি হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণাত্মক নিট বিনিয়োগ হয়েছে। অর্থাৎ এ সময় সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে নতুন কোনো ঋণ নেয়নি। বরং আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। যদিও অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে নিট বিনিয়োগ হয়েছিল ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদহার বাড়লেই যে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়বে- এটা ঠিক নয়। বর্তমানে স্থিতিশীল উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে অধিকাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় তাদের পক্ষে নতুন করে সঞ্চয় বা বিনিয়োগ কোনোটাই করার সামর্থ্য নেই। বরং আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন অনেকে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন,‘দেশের অর্থনীতির বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে বিনিয়োগ, মজুরি এবং শ্রমবাজার কোথাও খুব বেশি সুখবর নেই। শুধু রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাদে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কোনো খাতেই আয় বাড়ছে না। অন্যদিকে স্থিতিশীল রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। এই অবস্থায় নতুন করে সঞ্চয় করার মতো সক্ষমতা অধিকাংশ মানুষেরই নেই। যে কারণে সুদহার বাড়ানোর পরও সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়ছে না।’
সরকার তা হলে কেন সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়িয়েছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকার সঞ্চয়পত্রে যে সংস্কার করেছে সেটি মূলত সুদহার বাজারভিত্তিক করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সুদহার বাড়ানোর জন্য নয়। কারণ সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ না নিতে আইএমএফেরও পরামর্শ রয়েছে।’
জানা গেছে, মূলত আইএমএফের পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারিত হবে। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়বে। আর ট্রেজারি বিলের সুদহার কমলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমবে। বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণচুক্তি রয়েছে সেখানেও সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানোর পরামর্শ রয়েছে। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি হিসেবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ করে, সঞ্চয়পত্র থেকে তার এক চতুর্থাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবে না। সেই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করতে হবে।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে সঞ্চয় অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে খবরের কাগজকে বলেন, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সবসময়ই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বেশি হয়। মূলত আয়কর রিটার্নে বেশি হারে কর রেয়াত পাওয়ার জন্যই গ্রাহকরা এই সময় সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করেন। পরের মাসগুলোতে সেটা আবার কমে যায়। আর এই কারণেই অর্থবছরের সাত মাসে নতুন সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে নগদায়নের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হয়েছে ঋণাত্মক ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময় গ্রাহকরা নতুন বিনিয়োগ করার চেয়ে নগদায়ন বেশি করেছেন। সঞ্চয়পত্রের এই নিট বিনিয়োগই চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’।
নিয়ম অনুযায়ী, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ঋণাত্মক ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকাও ঋণ নেয়নি। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফা সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সম্ভাব্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ সুদ হবে। অন্যদিকে একই মেয়াদের পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ হবে। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর স্থায়ী আমানতে সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর এর বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এদিকে বর্তমানে ব্যাংকগুলো সাধারণত স্থায়ী আমানতে ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদ দেয়। তবে তারল্য সংকটে থাকা কিছু ব্যাংক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে ১১ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ পান গ্রাহক। অর্থাৎ আগে ব্যাংকের আমানত এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার অনেক বেশি থাকলেও বর্তমানে সেটা অনেক কমে গেছে।