
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রাম। এটি ‘বাঁশি গ্রাম’ নামে পরিচিত। সারা বছরই এখানে বাঁশি তৈরি হয়। বৈশাখ মাসকে সামনে রেখে কারিগরদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। কারিগররা জানান, এ বছর শ্রীমদ্দি গ্রাম থেকে প্রায় ৫ কোটি পিস বাঁশি তৈরি হয়েছে। উৎপাদন খরচ প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এ বছর ৪০ কোটি টাকার বাঁশি বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু বৈশাখ উপলক্ষে ২ কোটি টাকার বাঁশি তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতে বাঁশি বিদেশে রপ্তানির পরিকল্পনা করছেন।
কুমিল্লা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে শ্রীমদ্দি গ্রামের অবস্থান। গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায় রাস্তার দুই পাশে নলের গাছ। এগুলোই বাঁশি তৈরির মূল উপকরণ।
গ্রামের প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি পরিবার বাঁশি তৈরির সঙ্গে জড়িত। এটি তাদের প্রধান পেশা। প্রায় ১৫০ বছর আগে অধিবাস মণ্ডল প্রথম এই গ্রামের বাঁশি তৈরির কাজ শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে পুরো গ্রামে এই কাজ ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথমে খেত থেকে নল সংগ্রহ করা হয়। পরে এগুলো পরিষ্কার করে কেটে রোদে শুকানো হয়। এরপর ১৫ ধাপে বাঁশি তৈরি হয়। নারীরা বাঁশি তৈরির মূল কাজ করেন। পুরুষরা এগুলো বাজারজাত করেন।
একটি সাধারণ (সাদা) বাঁশির উৎপাদন খরচ ২ টাকা ৫০ পয়সা। পাইকারি বিক্রয় মূল্য ৪ টাকা। রঙিন বাঁশির ক্ষেত্রে খরচ পড়ে ৫ টাকা ৫০ পয়সা। পাইকারি মূল্য ৬ থেকে ৭ টাকা। খুচরা বাজারে সাদা বাঁশি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৫ টাকা। রঙিন বাঁশি বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ টাকায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে এসে বাঁশি কিনে নিয়ে যান। নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি রঙিন কাগজ পেঁচিয়ে বাঁশি সাজান। এতে তাদের বাড়তি আয় হয়।
কারিগররা জানান, রঙিন কাগজ ও অন্যান্য উপকরণের দাম বেড়েছে। এতে লাভ কমে গেছে। জরির দাম কেজিতে ২০০ টাকা বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে। এক কেজিতে ৪ হাজার পিস বাঁশি সাজানো যায়। টেপ লাগে ২০টি। প্রতি পিসের দাম ১৩ টাকা। সাদা জরির দাম ৭০ টাকা বেড়ে এখন ১৫০ টাকা। ১৬০ টাকার বেলুনের প্যাকেট এখন ২২০ টাকা।
গৃহবধূ শর্মিলা মণ্ডল বলেন, ‘সংসারের কাজের পাশাপাশি বাঁশিতে জরি পেঁচাই। প্রতি হাজার পিসে মজুরি পাই ১৮০ টাকা। দুই দিনে এক হাজার টাকার কাজ করা যায়।’
৩০ বছর ধরে বাঁশি তৈরির সঙ্গে জড়িত হাকিম হাওলাদার। তার নিজস্ব জমি নেই। দূর থেকে নল কিনে এনে বাঁশি তৈরি করেন। এ বছর তিনি ৮০ থেকে ৯০ হাজার পিস বাঁশি তৈরি করবেন। তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জ, সিলেট থেকে পাইকাররা এসে বাঁশি কিনে নেন। কখনো কুরিয়ারে পাঠানো হয়। নিজেও বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করি। এবার বৈশাখ উপলক্ষে ২০ হাজার পিস বাঁশি তৈরি করেছি। এতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ হবে।’
স্থানীয়রা জানান, গ্রামের যতীন্দ্র বাবুর স্ত্রী রীনা রাণী নকশী বাঁশি তৈরি করেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই এই কাজে দক্ষ। তারা বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বাঁশি রপ্তানি করেন। রপ্তানির গন্তব্য সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, জাপান, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র।
পাইকার আমির হোসেন বলেন, ‘এ বছর বৈশাখের আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে। মেলাগুলো জমজমাট হচ্ছে। বিক্রিও ভালো হচ্ছে। এক মাসে শ্রীমদ্দি গ্রাম থেকে প্রায় দুই কোটি টাকার বাঁশি বিক্রি হবে।’
কারিগররা জানান, বৈশাখী মেলার বাইরেও আরও অনেক মেলায় বাঁশি বিক্রি হয়। যেমন হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালিবাড়ীর মেলা, কচুয়ার রথমেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খরমপুর মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলি খেলা, নাঙ্গলবন্দের স্নানোৎসব, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়ার লালন উৎসব, গাজীপুরের মৌসুমি মেলা। এ ছাড়া শহর-বন্দর, হাট-বাজারে সারা বছরই বিক্রি হয়।
বাঁশিশিল্পী আবদুল খালেক বলেন, ‘বাঁশের দাম অনেক বেড়েছে। রং, কয়লা, স্পিরিটসহ সব উপকরণের দামই বেশি। কিন্তু বাঁশির দাম বাড়েনি। এতে আমাদের লাভ কমে গেছে।’