পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর শেয়ার ক্রয়ে মার্জিন ঋণ না দেওয়ার প্রস্তাব করেছে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে গঠিত সংস্কার টাস্কফোর্স। এ ছাড়া যেসব বিনিয়োগকারীর দুটি বিও হিসাব রয়েছে, তার একটি যদি মার্জিন ঋণের মাধ্যম বিনিয়োগ করে লোকসান হয়, তাহলে অপর নন-মার্জিন হিসাবের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) আগারগাঁও বিএসইসির মাল্টিপারপাস হলে মার্জিন ঋণের বিষয়ে টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে টাক্সফোর্সের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে আমরা এ-সংক্রান্ত সব অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি। তারপরও আমাদের এই প্রতিবেদনে কোনো অংশ নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত থাকলে আমরা অনুরোধ জানাব, আপনারা আমাদের সংশোধন করে দেবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি এবং সিইও মো. মনিরুজ্জামান সার্বিক বিষয় উপস্থাপন করে বলেন, মার্জিন রুলস, ১৯৯৯ যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স ‘মার্জিন রুলস’সংক্রান্ত চূড়ান্ত সুপারিশ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে একজন বিনিয়োগকারী ১:১ অনুপাতে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত মার্জিন ঋণ নিতে পারবেন বলে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে টাস্কফোর্সের কাছে ১:০.৫ অনুপারে মার্জিন ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন পুঁজিবাজার অংশীজনরা।
নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ৩০ দিন পর্যন্ত যেই কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে মার্জিন ঋণ না দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে তা অন্তত তিন মাস পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই তিন মাসের সেই কোম্পানির কোনো না কোনো প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই কোম্পানি মার্জিন ঋণ পাবে কি না, সেটি নির্ধারণ করা যাবে।
তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিষয়ে টাস্কফোর্সের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চুক্তিভিত্তিক হয়ে থাকে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেল সেগুলোর নতুন করে অনুমোদন পাবে কি না তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। এ জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের শেয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে মার্জিন ঋণ না দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, যেকোনো বিনিয়োগকারীর দুটি অ্যাকাউন্ট থাকে এবং এর একটি যদি মার্জিন ঋণের হিসাব হয় আর অপরটি নন-মার্জিন অ্যাকাউন্ট হয় তাহলে মার্জিন ঋণের হিসাবে শেয়ারের দাম ক্রয়মূল্যের চেয়ে কমে গেলে অপর অ্যাকাউন্টের শেয়ার বিক্রি করে তার হিসাব সমন্বয় করা যাবে। এমন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মার্জিন ঋণের অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ হলে ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান তারল্য সমস্যার সম্মুখীন হন এবং সেই বিনিয়োগকারীও লোকসানের কারণে নতুন বিনিয়োগ করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে অপর হিসাব থেকে ঋণ সমন্বয় করা হলে প্রতিষ্ঠানের জন্য তা ভালো হবে। বিনিয়োগকারীও ঋণমুক্ত হবেন।
পেনশনহোল্ডার, শিক্ষার্থী বা গৃহিণীদের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা থাকে না। তারা মার্জিন ঋণ নিলে অনেক সময় সমস্যায় পড়ে যান। নিয়মিত আয় না থাকায় মার্জিন ঋণ পরিশোধ তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। সে জন্য যাদের নিয়মিত আয় আছে মার্জিন ঋণ নিলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হন না, বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এ জন্য আমরা যাদের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা আছে, তাদের জন্যই মার্জিন ঋণের সুপারিশ করা হয়েছে।
টাস্কফোর্সের সুপারিশে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বাড়ি ভাড়া পান, তার কিন্তু আয়ের একটা ব্যবস্থা আছে। মার্জিন ঋণ তার জন্য রেস্ট্রিক্টেড না। কিন্তু যাদের নিয়মিত আয় থাকে না, যেমন- অবসরের পর যে ভাতা পাওয়া যায় তা দিয়ে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ঋণ পরিশোধ করা কঠিন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর কোথাও মার্জিন ঋণ দীর্ঘ সময়ের জন্য দেওয়া হয় না। এ ঋণ নিয়ে সাধারণত বাজার সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা দক্ষ বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা করেন। তারা স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ নিয়ে তা দ্রুত পরিশোধ করে দেন।
এর আগে গত রবিবার বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ কাছে মার্জিন রুলস, ১৯৯৯-এর যুগোপযোগীকরণে চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেন পুঁজিবাজারের উন্নয়নে গঠিত সংস্কার টাস্কফোর্স। এ সময় কমিশনার মো. আলী আকবর ও কমিশনার ফারজানা লালারুখ উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া সংস্কার টাস্কফোর্সের পক্ষে টাস্কফোর্সের সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন উপস্থিত ছিলেন।
গত ৭ অক্টোবর ২০২৪ পুঁজিবাজার উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্সের সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোংয়ের জ্যেষ্ঠ অংশীদার এ এফ এম নেসারউদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন।
বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। এরই মধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংক, আইপিও ও মার্জিন ঋণের বিষয়ে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে কমিশনে। এর মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজারের আকার, তথা জিডিপি ও বাজার মূলধন অনুপাত কম হওয়ার প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করা ও উন্নতির জন্য নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংকঋণের বদলে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়নে সরকারের নীতি প্রণয়ন ও এ–সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএসইসির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের সুপারিশ করা; বাজারের সুশাসনের উন্নতির জন্য বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করে সমাধানের সুপারিশ প্রণয়ন; বিএসইসির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ; ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএল, সিসিবিএলের তদারকি কার্যক্রম বিশ্বমানে উন্নীত করাসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিতে সুপারিশ প্রণয়ন; প্রাইভেট প্লেসমেন্টসংক্রান্ত সিকিউরিটিজ নীতিমালা যুগোপযোগী করতে সুপারিশ; তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, করপোরেট ঘোষণাসহ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও বাজারের গভীরতা বৃদ্ধির সুপারিশ প্রণয়ন; বাজার মধ্যস্থতাকারীদের জন্য বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান যুগোপযোগী করতে সুপারিশ করা; বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও আস্থা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান; বাজারে কারসাজি, অনিয়মের বিচার ও জরিমানার সমতা আনতে সুনির্দিষ্ট পেনাল কোড এবং শাস্তির বিধিমালা প্রণয়ন করা; নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি মানসম্মত পদ্ধতি বা নির্দেশিকা প্রণয়ন; তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে অ–তালিকাভুক্ত কোম্পানি একীভূত, অধিগ্রহণসংক্রান্ত হাইকোর্টের অনুমোদনের আগে বিএসইসির অনাপত্তি গ্রহণসংক্রান্ত সুপারিশ করা ইত্যাদি।