বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ বেশ প্রতিকূল। মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা কমে গেছে। ফলে আমাদের মতো কোম্পানিগুলো এখন ‘ভ্যালু ফর মানি’বা ভালো মানের পণ্য সাশ্রয়ী দামে কীভাবে দিতে পারে, সেটাতে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা আপাতত মিড-রেঞ্জ ও এন্ট্রি লেভেল প্রোডাক্টের ওপর বেশি ফোকাস করছি। তবে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আবার প্রিমিয়াম সেগমেন্টে ফিরব।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। একসময় যেখানে সাধারণ এসি, রেফ্রিজারেটর আর টিভিই ছিল প্রধান, এখন সেখানে এসেছে এলজির ডুয়েল ইনভার্টার প্রযুক্তি, যা বিদ্যুৎসাশ্রয়ে অনেক কার্যকর। Panasonic MirAi টেকনোলজি গ্রাহকদের মধ্যে ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এ ছাড়া Whirlpool তাদের 6th Sense টেকনোলজি, Hisense-এর AI-বেইসড স্মার্ট ফিচারস গ্রাহকদের লাইফস্টাইল আরও স্মার্ট ও সহজ করে তুলেছে।
দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোও পিছিয়ে নেই। Walton এখন নিজেদের R&D-এর মাধ্যমে নতুন ফিচারগুলো নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে, এখনকার হোম অ্যাপ্লায়েন্স খাত শুধু প্রয়োজনীয়তা নয়, বরং একটি লাইফস্টাইল সলিউশন হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রাহকদের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তাই এই সেগমেন্টে প্রতিযোগিতা তীব্র। স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো দামে বেশি সুবিধা দিলেও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো নির্ভরযোগ্যতা ও দীর্ঘস্থায়িত্বে এগিয়ে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী আমরা দুটোরই সমন্বয়ে কাজ করছি।
আমরা চেষ্টা করি যেসব পণ্য স্থানীয়ভাবে ভালো মানে তৈরি হচ্ছে, সেগুলো দেশেই উৎপাদন করতে। আর যেসব পণ্যে এখনো প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে, সেগুলো আমদানি করে সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে দিচ্ছি।
এই খাতে সফল হতে হলে ধৈর্য, দূরদৃষ্টি আর বাস্তবিক বাজার বিশ্লেষণ খুব জরুরি। বিশেষ করে এখন যেহেতু হোম অ্যাপ্লায়েন্স ক্রমশ স্মার্ট হয়ে উঠছে, IoT (Internet of Things) ভিত্তিক প্রযুক্তির দিকে তরুণদের নজর দেওয়া উচিত। ভবিষ্যতের গ্রাহক চাইবে এমন পণ্য যা স্মার্টফোন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যেটা তাদের বিদ্যুৎ খরচ হিসাব করে দেয়, এমনকি সময় অনুযায়ী নিজেদের অ্যাডজাস্ট করে।
Best Electronics আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ১৯০টি আউটলেট এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে মোট ৪০০টি আউটলেট চালু করা।
তবে শুধু অফলাইন নয়, আমরা সমান গুরুত্ব দিচ্ছি অনলাইন প্ল্যাটফর্মকেও। আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ই-কমার্স চ্যানেলের মাধ্যমে ঘরে বসেই পণ্য কেনার অভিজ্ঞতা দিচ্ছি গ্রাহকদের।
আমরা সব সময় চেষ্টা করি কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে। প্রোডাক্ট কোয়ালিটি, আফটার সেলস সার্ভিস এবং ট্রান্সপারেন্ট প্রাইসিং আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু গড়ে তুলেছে।
বর্তমান কর কাঠামোতে কিছু ইতিবাচক দিক আছে, তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। গত সরকার শুধু স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য একচেটিয়া কর সুবিধা দিয়েছে, যা অবশ্যই দেশীয় শিল্প বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই একতরফা সুবিধার ফলে যারা শুধু অ্যাসেম্বলি বা ইনোভেটিভ, নিস পণ্য আমদানি করে দেশেই অ্যাসেম্বল করে বিক্রি করতেন, তাদের অনেকেই ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছেন।
সব গ্রাহক এক রকম পণ্য চান না—অনেকেই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের এক্সক্লুসিভ, প্রিমিয়াম প্রোডাক্ট খোঁজেন যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন সম্ভব নয় বা করে লাভজনক হয় না। তাই, এমন অ্যাসেম্বলারদের জন্যও কর কাঠামোতে কিছু যৌক্তিক সুবিধা থাকা দরকার, যাতে তারা সীমিত কিন্তু উচ্চমানের পণ্য বিক্রি করে নির্দিষ্ট ক্রেতাদের সেবা দিতে পারেন।
এ বছর পরিস্থিতি বেশ অনিশ্চিত। সাধারণত মার্চ মাস থেকেই এসি বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু এ বছর এপ্রিলেও সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এর ওপর ঈদুল ফিতরেও সার্বিকভাবে সব কোম্পানির বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়েছে।
আমরা আশা করছি, ঈদুল আজহা উপলক্ষে নতুন রেঞ্জের ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজার এবং গ্রাউন্ড ব্রেকিং প্রমোশনাল অফারের মাধ্যমে বাজারে একটি পজিটিভ টার্নআরাউন্ড হবে। আমাদের ফোকাস থাকবে সাশ্রয়ী দামের ভালো মানের পণ্য এবং সহজ কিস্তির মাধ্যমে গ্রাহককে আকৃষ্ট করা।
আমরা এখন ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি বিক্রি করছি, যা বিদ্যুৎসাশ্রয়ে অত্যন্ত কার্যকর। একই সঙ্গে Energy Rating নিশ্চিত করছি যেন গ্রাহক জানেন কী পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হবে।
বাংলাদেশে ই-ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনায় এখনো অগ্রগতি সীমিত। কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন পুরোনো মোবাইল ফোনের PCB থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহের জন্য ছোট আকারে রিসাইক্লিং প্লান্ট গড়ে তুলেছে, কিন্তু এগুলো এখনো বাণিজ্যিকভাবে খুব সীমিত পর্যায়ে চলছে।
এই খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে যদি আমরা বিদেশি বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দিকনির্দেশনা পাই। যথাযথ রিসাইক্লিং প্রযুক্তি এবং সরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে ই-ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনা শুধু পরিবেশবান্ধবই হবে না, বরং নতুন কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বারও খুলে যাবে।
আমরা সব সময় দীর্ঘস্থায়ী এবং মানসম্পন্ন পণ্য বাজারে দিতে চেষ্টা করি। প্রযুক্তি আপডেট করা ও কাঁচামালের দাম বাড়া এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ব্র্যান্ডের মান ধরে রাখতে আমরা কোনো আপস করি না।
রপ্তানির সম্ভাবনা অনেক। তবে দাম, মান এবং সার্টিফিকেশন—এই তিনটা বিষয়ে আমাদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতনির্ভর কিছু দেশে ইতোমধ্যে কিছু সুযোগ তৈরি হচ্ছে।