
গত বছরের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলো করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর খাতে প্রায় ৩০৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় কম। আগের বছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩৫৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় গত ছয় মাসে সিএসআর খাতে ব্যয় কমেছে ৪৬ কোটি বা ১৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
সিএসআর ব্যয় কমার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে এ ব্যয়ের বড় অংশই বরাদ্দ দেওয়া হতো প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ (বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা) তহবিলে। যেকোনো উপলক্ষ কিংবা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাংক চেয়ারম্যান কিংবা এমডিরা সিএসআরের অর্থ জমা দিতেন গণভবনে গিয়ে। আর এ খরচের অর্থই দুর্যোগব্যবস্থাপনা খাতে দেখায় ব্যাংকগুলো। ফলে এ উপ-খাতে কয়েক বছর ধরে সর্বোচ্চ সিএসআর ব্যয় হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে আর সেই বরাদ্দ দিতে হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর সিএসআর ব্যয় কম দেখাচ্ছে। তবে বেড়েছে অন্যান্য খাতে।
এ প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী খবরের কাগজকে বলেন, সিএসআর ব্যয় আসলে কমছে না, বরং বাড়ছে। আগে এ ব্যয়ের একটা বড় অংশ চলে যেত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে, এখন যেটা আর দেওয়া লাগছে না। সেজন্য মনে হচ্ছে সিএসআর ব্যয় কমে
যাচ্ছে। অর্থাৎ সংখ্যায় কম মনে হলেও প্রকৃত খাতেই ব্যয় হচ্ছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলো সিএসআর ব্যয় করেছে ৩০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। যা আগের ছয় মাসে ছিল ৩০৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালে সিএসআর খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ৬১৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় ৩৪ শতাংশ কম। শুধু তাই নয়, এটি গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে সর্বনিম্ন সিএসআর ব্যয় ছিল ২০১৬ সালে। ওই বছর ব্যাংকগুলোর ব্যয়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে প্রতি বছরই সিএসআর ব্যয় বাড়তে থাকে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে ব্যাংকগুলো এ খাতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল। তবে ২০২৩ সালে সেটি কমে দাঁড়ায় ৯২৪ কোটি টাকা। আর গত বছর আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৬১৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সিএসআর খাতে ব্যয় করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট সিএসআর ব্যয়ের ৩০ শতাংশ শিক্ষা খাতে, স্বাস্থ্য খাতে ৩০ শতাংশ, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রশমন ও অভিযোজন খাতে ২০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। বাকি ২০ শতাংশ আয়-বৃদ্ধিমূলক কাজ, দুর্যোগব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি এবং অন্যান্য খাতের আওতায় ব্যয় করার নির্দেশনা রয়েছে। তবে প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর মোট সিএসআর ব্যয়ের মধ্যে দুর্যোগব্যবস্থাপনা উপ-খাতেই করা হয়েছে ২৮৯ কোটি টাকা বা ৪৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ সময়ে শিক্ষা খাতে করা হয়েছে মাত্র ১০৮ কোটি ১১ লাখ টাকা বা ১৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে করা হয়েছে ১৫৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বা ২৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন খাতে করা হয়েছে ২২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বা ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
সিএসআর ব্যয়ে শীর্ষ ১০ ব্যাংক : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের শেষ ছয় মাসে দেশে সিএসআর ব্যয়ের শীর্ষে ছিল বেসরকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকটি এ খাতে প্রায় ৩১ কোটি টাকা খরচ করেছে। এই তালিকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দ্বিতীয়, এক্সিম ব্যাংক তৃতীয়, ব্র্যাক ব্যাংক চতুর্থ ও যমুনা ব্যাংক পঞ্চম স্থানে ছিল। এ ছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম অবস্থানে ছিল যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডই শুধু বিদেশি ব্যাংক, বাকিগুলো দেশি। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কিছু ব্যাংকের সিএসআর খাতে অতীতে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটেছে। সিএসআরের অর্থ লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে সিএসআরের অর্থ ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
শর্ত মানেনি নতুন ব্যাংক : ব্যাংকগুলোকে প্রকৃত মুনাফার ১০ শতাংশ অর্থ সিএসআর খাতে খরচ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু সে শর্ত ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই মানেনি। এ রকম ব্যাংকগুলো হলো এসবিএসি, মধুমতি, মিডল্যান্ড, সীমান্ত, এনআরবি কমার্শিয়াল, ইউনিয়ন, মেঘনা, গ্লোবাল ইসলামী ও সিটিজেনস ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, শর্ত মেনে শুধু এনআরবি ও কমিউনিটি ব্যাংক মুনাফার ১০ শতাংশ সিএসআর খাতে খরচ করেছে।
এক টাকাও ব্যয় করেনি ৬ ব্যাংক : প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ছয়টি ব্যাংক সিএসআর খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। এগুলো হলো- বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংক। এসব ব্যাংকের অধিকাংশই মুনাফা করতে পারেনি। তাই তারা সিএসআর খাতে ব্যয় করেনি।