
নতুন বাজার সন্ধান, পণ্যের বহুমুখীকরণ, আলাদা পোশাক ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষাসহ একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজিএমইএর নির্বাচনি জোট ফোরাম নেতারা। তারা বলেছেন, অনিয়ন্ত্রিত কারণে কোনো তৈরি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হলে, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং মালিকের জন্য একটি কার্যকর এক্সিট পলিসি প্রণয়নে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।
গতকাল ফোরামের প্যানেল লিডার মাহমুদ হাসান খান বাবু রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন।
আগামী ৩১ মে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে তিনটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূলত লড়াই হবে ফোরাম এবং সম্মিলিত পরিষদের মধ্যে। এই নির্বাচনে ৩৫টি পদের বিপরীতে ৭৬ প্রার্থী লড়বেন।
অনুষ্ঠানে মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস, যেখান থেকে প্রায় ৮৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এই খাত একদিকে অর্থনীতি ও জিডিপিতে যেমন অবদান রাখছে, পাশাপাশি কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক সুরক্ষা ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।’
তবে এটিও সত্য, নানা প্রতিকূলতা আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এ শিল্প ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকলেও, এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও টেকসই উন্নয়নে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএ শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় শক্তিশালী ও পেশাদার ভূমিকা রাখার প্রত্যাশা সব সদস্যের। এমন বাস্তবতায় পোশাকশিল্পের সব উদ্যোক্তা একটি স্বচ্ছ, গতিশীল, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক বিজিএমইএ গঠনের জোর দাবির সঙ্গে আমাদের সংগঠন ফোরাম একাত্মতা প্রকাশ করছেন।
মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘ফোরামের পক্ষ থেকে পোশাক খাতের জন্য আমরা কয়েকটি অগ্রাধিকারের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। তবে, সময়ের সঙ্গে সামনে আসবে অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলা করতে হবে। দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিজিএমইএ গড়ে তুলতে হবে আমাদের। সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বার্থে বিজিএমইএকে নেতৃত্ব দিতে হবে সামনে থেকে।’
‘বস্ত্র ও পোশাকশিল্প মন্ত্রণালয়’ গঠন:
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পোশাকশিল্পের অগ্রযাত্রার জন্য সরকারের নীতি সহায়তা চলমান থাকতে হবে। এ মুহূর্তে পোশাকশিল্প সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হতে হয়। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক বিষয়ের কারণে ব্যাপক সময় ব্যয় করতে হয়। যেখানে শুধু পোশাকশিল্পকে যথেষ্ট সময় দেওয়া মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। পোশাকশিল্পের সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আমাদের অনেক দিনের। আমাদের প্রস্তাব, এ লক্ষ্যে নতুন কোনো মন্ত্রণালয় না করে বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে পুনর্গঠন করে ‘বস্ত্র ও পোশাকশিল্প মন্ত্রণালয়’ গঠন করা দরকার।
এসএমই, নন-বন্ড ফ্যাক্টরি ও নতুন উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা:
ফোরামের প্যানেল লিডার বলেন, ‘পোশাক খাতের ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ অনেক দিনের। আমাদের মনে রাখা দরকার, বর্তমানের ছোট শিল্পই, আগামী দিনের বড় শিল্পে পরিণত হবে। তাই এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সঙ্গে তাদের প্রযুক্তি সহায়তা এবং মার্কেট এক্সেস বৃদ্ধিতে বিশেষ ফান্ড গঠন করা দরকার।’
কাস্টমস অটোমেশন ত্বরান্বিতকরণ:
মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘কাস্টমস নিরীক্ষা (অডিট) নিয়ে আমাদের হয়রানি থামছে না। আমরা এই হয়রানিতে যেতে চাই না। প্রয়োজনে সর্বোচ্চ র্যাংকধারী অডিট ফার্ম নিয়োগ দিয়ে অডিট প্রক্রিয়া আউটসোর্সিং করতে হবে। ডিজিটাল ক্লিয়ারেন্স সিস্টেম চালু করে রপ্তানি-আমদানি প্রক্রিয়ায় সময় ও ব্যয় কমানো দরকার।’
শিল্পের নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা:
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের বয়স ৪৫ বছর। তবে, এখনো খাতটি টেকসই করে গড়ে তোলা যায়নি। পোশাক খাত টেকসই করতে আমাদের শিল্পের নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা- এ তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর এ জন্য দরকার সমন্বিত সুশাসন, কমপ্লায়েন্স সনদ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এ লক্ষ্যে শিগগিরই উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে আমি মনে করি।
প্রকৃত রপ্তানিকারকদের সদস্যপদ নিশ্চিতকরণ:
বিজিএমইএর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে সাত হাজারের বেশি। কিন্তু বিগত বছরে নির্দিষ্ট মানদণ্ড উপেক্ষা করে অনেককে সদস্য করা হয়েছে। এগুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে। কারণ, কোনো একটি কারখানায় দুর্ঘটনা সংগঠিত হলে তার দায় পুরো খাতের ওপর চলে আসবে। নির্দিষ্ট মানদণ্ড উপেক্ষা করে সদস্য পদ দেওয়া থেকে ফোরাম বিরত থাকবে।
প্রধান রপ্তানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ও পণ্যের বহুমুখীকরণ:
মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাকের বাজারের গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। বাজার বহুমুখীকরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে চাই। আমরা কটন বেসড পণ্য থেকে ম্যান মেইড ফাইবারের পণ্যের দিকে নজর দিতে চাই।’
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা:
ফোরামের প্যানেল লিডার বলেন, ‘আমরা যারা নির্বাচিত হতে চাই, তারা মালিক-উদ্যোক্তাদের কাছে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি। কিন্তু নির্বাচনের পর, তা ভুলে যান অনেকে। ফোরাম থেকে, যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে, তা বাস্তবায়ন করা এবং মেম্বারদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদারকি করার জন্য প্রতিজন নির্বাচিত পরিচালক ৫০-৭০টি কারখানার দায়িত্বে থাকবেন।’
শিল্পজোনভিত্তিক ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল:
মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘বিজিএমইএর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল এখন কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত। কিন্তু এটিকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। শিল্পাঞ্চলভিত্তিক সেল গড়ে তোলা হবে, দায়িত্ব দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিচালকদের। সেই সঙ্গে বিজিএমইএর কর্মকর্তা ও শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারাও সম্পৃক্ত থাকবেন। যেকোনো সমস্যায় যাতে তারা দ্রুত উদ্যোগ নিতে পারেন এ জন্য জোনভিত্তিক ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল গঠনের কথা বলছি আমরা।’