প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরীর দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৮ জুলাই)। তিনি বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের পথিকৃৎ ছিলেন। এ দেশের শিল্প খাতে আমজাদ খান চৌধুরীর অবদানের কারণে সবাই তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা শুরু করে গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক মানের একাধিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববাজারে এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৫ সালের ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় ডিউক মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকার বনানী সেনা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে।
১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আমজাদ খান চৌধুরী। ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমজাদ খান চৌধুরী তার চারপাশের মানুষকে প্রায় বলতেন, ‘দেশে রয়েছে উর্বর জমি, প্রচুর নদীনালা, বর্ষব্যাপী উৎপাদনকাল, সহজ ও কম খরচে যাতায়াতের উপযোগী পথঘাট এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমী এক বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা প্রথাগতভাবে কৃষক। প্রকৃতির অফুরন্ত এসব সম্পদ থাকার পরও আমরা কেন দরিদ্র থাকব। দেশের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদেই প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পথ চলা।’
প্রাণ-আরএফএল প্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলতেন, কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তির বিকল্প নেই।
অল্প খরচে কৃষিতে ব্যবহার উপযোগী যন্ত্র কীভাবে বানানো যায় সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন ব্যবসার এই দিকপাল। রংপুরে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)’।
প্রতিষ্ঠানে স্বল্প পরিসরে নানা ধরনের কৃষি উপকরণ তৈরি করতে থাকেন।
আমজাদ খান চৌধুরীর ব্যবসার পুঁজি ছিল পেনশনের টাকা। স্ত্রী সাবিহা আমজাদ পৈতৃক সম্পত্তি ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে তাকে আরও কিছু টাকা দেন। এ টাকায় প্রথমে অকশনের কিছু মেশিনপত্র জোগাড় করেন। যা দিয়ে হালকা কৃষি উপকরণ তৈরি করেন। এসব দিয়েই পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেন ব্যবসা। প্রাথমিক পর্যায়ে রাইস হলার (ধান ভাঙানোর মেশিন), কোদাল, বেলচা, কেরোসিন চুলা, ইঞ্জিনের পিস্টন-লাইনার ট্রেডল পাম্প, তারা পাম্প, রংপুর পাম্প ইত্যাদি ম্যানুয়াল কৃষি ও সেচ উপকরণ তৈরি করা হয়। বর্তমানে এসব উপকরণের আধুনিক সংস্করণ (ওয়াটার পাম্প, পাইপ, ফিটিংস) তৈরি করা হয় তার প্রতিষ্ঠানে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুম ছাড়াও কীভাবে কৃষকরা টিকে থাকতে পারে তা নিয়ে ভাবতেন। ব্যবসার এই দিকপালের চেষ্টা ছিল মৌসুম ছাড়াও কৃষককে লাভবান করা। তিনি প্রায় বলতেন, বছরের অন্য সময় কৃষকের তিন বেলা খেয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া মৌসুমের সময়ও তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। কৃষককে বাঁচাতে দেশের মানুষের খাদ্য সমস্যা সমাধানে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে। সে চেষ্টাই করে গেছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এই কর্ণধার।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে দেশের বৃহৎ খাদ্যসামগ্রী ও গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে খাদ্য ও গৃহস্থালি- এ দুটি খাতে সর্বাধিক বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা হয়। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লাস্টিক খাতে আছে ৫ হাজার ৫০০-এর বেশি পণ্য। খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির প্রোডাক্ট লাইনে রয়েছে ২ হাজার ৫০০টিরও বেশি পণ্য। এসব পণ্য দেশে উৎপাদনের জন্য দেশের ৩০টি জায়গায় প্রাণ আরএফএল গ্রুপের কারখানা রয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এখন বিশাল একটি পরিবার যেখানে ১ লাখ ৫৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছে। এ ছাড়া এ কর্মসংস্থান বেসরকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রুপের নির্ভরশীল প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কারখানায় নারী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের রপ্তানি বাড়াতে সব সময় চেষ্টা করতেন আমজাদ খান চৌধুরী। প্রাণকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ডে পরিণত করেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে ‘প্রাণ’-এর অর্জন বেড়েই চলেছে।
দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিজপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে উন্নত বিশ্বের ভোক্তাদের খাবার টেবিলে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। বিশ্বের এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন নেই কিন্তু সেখানে আমরা ‘প্রাণ’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা বহন করছি। ‘প্রাণ’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিচিতি বিস্তৃত করার চেষ্টা করেন আমজাদ খান চৌধুরী।
প্রাণ পণ্য সুদূর আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ ১৪৮টিরও বেশি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের কাছ থেকে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে অবদান রাখায় সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ পরপর ২১ বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করছে।
সব সময় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে এগিয়ে নিয়েছে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি তার কর্মীদের বলতেন, আমাদের লক্ষ্য হলো প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে বাংলাদেশের প্রথম বহুজাতিক কোম্পানি (মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
বিগত কয়েক দশকে দেশের সামগ্রিক কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলেও দুগ্ধশিল্প আশানুরূপ বিকাশলাভ করতে পারেনি। দুগ্ধশিল্প এমন একটি খাত যেখানে সব বয়সের নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নের জন্য আমজাদ খান চৌধুরী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রান্তিক পর্যায়ে দুগ্ধ খামারিদের পশুপালনবিষয়ক প্রশিক্ষণ, পশু চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ, রোগপ্রতিষেধক টিকা প্রদান, কৃত্রিম প্রজনন, গবাদিপশুর জন্য উপযুক্ত খাবার সরবরাহ, দুগ্ধখামারিদের সুসংহত করা ও তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
এ ছাড়া উৎপাদনকারীদের কাছে থেকে দুগ্ধ সংগ্রহের লক্ষ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুগ্ধ সংগ্রহ ও শীতলীকরণ কেন্দ্রের সূচনা করেন। বর্তমানে সারা দেশে প্রাণের ১১০টি দুগ্ধ সংগ্রহ রয়েছে।
পাস্তুরিত দুধের পাশাপাশি গুঁড়া দুধ উৎপাদনের জন্য তিনি বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। নরসিংদীর প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে প্লান্ট স্থাপন করেন। যেখানে গড়ে প্রতিদিন ২ লাখ লিটার তরল দুধ প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
প্রাণ-আরএফএল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাংলাদেশের কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কাজ করেছেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র চাষিদের রক্ষা করতে এবং তাদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে কাজ করেছেন। ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ তথা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ শুরু করেন। চাষিদের উন্নতমানের বীজ, সার-কীটনাশকের ব্যবস্থা করেছেন। কোন ফসলের জন্য বছরের কোন সময়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতেন। ফসল ওঠার পর তাদের কাছে থেকে তা কিনে নিতেন। কৃষক প্রতিনিধিসহ বাজারদর যাচাই করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে কিনে নিতেন। আমজাদ খান চৌধুরী সিংহভাগ কাঁচামাল সংগ্রহ করতেন ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ তথা চুক্তিবদ্ধ কৃষকদের মাধ্যমে।
তার কর্মীদের আমজাদ খান চৌধুরী বলতেন, কঠোর পরিশ্রম এবং নিয়মানুবর্তিতা সফলতার মূল শক্তি। মানুষের জীবনে সময় অত্যন্ত সীমিত। এই সীমিত সময়ে যদি সফলতা অর্জন করতে সময়মতো কাজ করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’ অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ছাড়া টিমওয়ার্ক, জব স্যাটিসফ্যাকশনও অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মনে করতেন।
১৯৩৯ সালে নাটোরে আমজাদ খান চৌধুরীর জন্ম। বাবা মরহুম আলী কাশেম খান চৌধুরী। আমজাদ খান চৌধুরী শিক্ষা জীবন শুরু করেন ঢাকায়, গ্র্যাজুয়েশন করেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি এবং অস্ট্রেলিয়ান স্টাফ কলেজ থেকে। তিনি ১৯৫৬ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণের পর বসে না থেকে ১৯৮১ সালে ছোট ঢালাই লোহার ফাউন্ড্রির মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র জনগণের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে টিউবওয়েল ও কৃষিকাজে সেচের পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে কৃষি সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করলেন। আমজাদ খান চৌধুরী সেই ফাউন্ড্রির নাম দিলেন রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড। সেখান থেকে আজকের এই প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পথচলা শুরু।
পারিবারিক জীবন
আমজাদ খান চৌধুরীর সহধর্মিণী মিসেস সাবিহা আমজাদ শুধু গৃহিণীই নন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এই দম্পতির চার সন্তান। তারা হলেন আজার খান চৌধুরী, ডা. সেরা হক, আহসান খান চৌধুরী ও উজমা চৌধুরী। তাদের মধ্যে আহসান খান চৌধুরী গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উজমা চৌধুরী গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ফিন্যান্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আমজাদ খান চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যিক সংগঠন রিহ্যাব, বাপা, ইউসেপসহ বিভিন্ন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ
রংপুরে ১৯৮১ সালে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেডের (আরএফএল) পথচলা শুরু। ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা শুরু করেও আজকে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ৩৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পাবলিক লিমিটেড দুটি কোম্পানি। অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি থেকে খাদ্য ও গৃহস্থালি- এ দুটি খাতে সর্বাধিক বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা হয়। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লাস্টিক খাতে আছে ৫ হাজার ৫০০-এর বেশি পণ্য। খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির প্রোডাক্ট লাইনে রয়েছে ২ হাজার ৫০০টিরও বেশি পণ্য। এসব পণ্য দেশে উৎপাদনের জন্য দেশের ৩০টি জায়গায় প্রাণ আরএফএল গ্রুপের কারখানা রয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এখন বিশাল একটি পরিবার যেখানে ১ লাখ ৫৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছে। এ ছাড়া এ কর্মসংস্থান বেসরকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রুপের নির্ভরশীল প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।