দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্টার্ট-আপ উদ্যোগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন বাড়াতে চায় সরকার। সেই লক্ষ্যে স্টার্ট-আপ অর্থায়ন সংক্রান্ত নীতিমালায় বেশকিছু পরিবর্তন এনে বুধবার (৯ জুলাই) সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফার ১ শতাংশ দিয়ে আলাদা স্টার্ট-আপ তহবিল গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। নতুন নিয়মে, এই তহবিল থেকে ব্যাংক গুলো ঋণ দিতে পারবে না। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা একটা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি করবে। এখান থেকে স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন সুবিধা পাবে। মালিকানা ব্যাংকেরই থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছিল, সেটা আগের মতোই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল আকারে চালু থাকবে।
নতুন নিয়মে, বেশকিছু শর্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে যেখানে বয়সসীমা ছিল ২১ থেকে ৪৫ বছর। নতুন নীতিমালায় ২১ বছরের ওপরে যে কেউ ঋণ নিতে পারবে। অর্থাৎ বয়সের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন ৬৫ বা ৭০ বছরের কেউ চাইলেও ঋণ নিতে পারবে। আগে ঋণ সীমা ছিল ১ কোটি। এখন সেখানে তিনটা পর্যায়ে ঋণ নিতে পারবে। ২ কোটি, ৫ কোটি এবং সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারবেন।
এর আগে, উদ্ভাবনী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে তিন বছর আগে ২০২১ সালের মার্চে বিনা জামানতে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়াতে ‘স্টার্ট-আপ ফান্ড’ নামে ৫০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়। একই সঙ্গে প্রতি ব্যাংকের নিট মুনাফা থেকে ১ শতাংশ আলাদা রেখে নিজস্ব স্টার্ট-আপ তহবিল গঠন করতে বলা হয়। ব্যাংকগুলো সব মিলিয়ে ৫০৫ কোটি টাকার ফান্ড গঠনও করেছে। দুটি মিলিয়ে গত আগস্ট পর্যন্ত স্টার্ট-আপে ঋণ দেওয়ার জন্য গঠিত তহবিলের আকার দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫ কোটি টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকার ঋণও বিতরণ করা হয়নি।
স্টার্ট-আপ বলতে বাজারজাত করার জন্য নতুন পণ্য, সেবা, প্রক্রিয়া বা প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও অগ্রগতিকে বোঝায়। এ পর্যন্ত শেয়ারট্রিপ, চালডালের মতো হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্টার্ট-আপের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় কম সুদের ঋণ পেয়েছে।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্ভাবনে চালিকাশক্তি হিসেবে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ব্যবসাক্ষেত্রে উদ্ভাবনী অবকাঠামো তৈরি, বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ সুবিধার সঙ্গে সুযোগের পাশাপাশি স্টার্ট-আপ উদ্যোগগুলো নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি মূল লক্ষ্য। উচ্চ সম্ভাবনাময় স্টার্ট-আপ উদ্যোগসমূহে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন গতিশীল করতেই নতুন সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, স্টার্ট-আপ উদ্যোগের ক্ষেত্রে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বাতিল করা হয়েছে। এখন ২১ বছরের ওপরে যে কেউ চাইলে ঋণ নিতে পারবে। ঋণের সীমা বাড়িয়ে ৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে এই পরিমাণ ঋণ পেতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে অবশ্যই নিবন্ধনের সময় থেকে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে।
স্টার্ট-আপ উদ্যোগে অর্থায়ন পদ্ধতি ও অর্থায়ন সীমা দুটোতেই ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের স্টার্ট-আপ ফান্ড হতে শুধুমাত্র ঋণ বা বিনিয়োগ সুবিধা দিতে পারত। নতুন প্রণীত মাস্টার সার্কুলার মোতাবেক স্টার্ট-আপ উদ্যোগের অনুকূলে ঋণ বা বিনিয়োগের পাশাপাশি ইক্যুইটি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে ব্যাংকের গঠিত নিজস্ব ‘স্টার্ট-আপ ফান্ড’ হতে স্টার্ট-আপ উদ্যোগে শুধু ইক্যুইটি বিনিয়োগ সুবিধা দিতে পারবে, স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানসমূহে ইক্যুইটি হিসেবে আর্থিক বিনিয়োগ সহজতর করার প্রয়াসে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। উক্ত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানে তফসিলি ব্যাংকসমহূ কর্তৃক তাদের স্টার্ট-আপ ফান্ডে রক্ষিত সমুদয় অর্থ ইক্যুইটি হিসেবে বিনিয়োগ হবে যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণীতে ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হবে। উক্ত কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল গঠন নিয়ে পরবর্তীতে আলাদা গাইডলাইন দেওয়া হবে বলেও সার্কুলারে জানানো হয়েছে। স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের অনুকূলে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে তাদের নিজস্ব বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ব্যবহার করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের নিজস্ব বিনিয়োগযোগ্য তহবিল হতে স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের অনুকূলে ঋণ দিতে পারবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের অনুকূলে বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গঠিত ‘স্টার্ট-আপ ফান্ড’ নামে ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল হতে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। তবে নতুন সার্কুলার জারির পর থেকে ব্যাংকের নিজস্ব ‘স্টার্ট-আপ ফান্ড’ থেকে স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের অনুকূলে নতুন করে কোনো ঋণ বিতরণ করা যাবে না। তবে, ইতোমধ্যে মঞ্জুরীকৃত ঋণের অর্থ ছাড় করা যাবে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব ঋণ তহবিল হতে স্টার্ট-আপ উদ্যোক্তাদের অনুকূলে ঋণ গ্রাহক পর্যায়ে ছাড় করার ক্ষেত্রে অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ০ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণ করবে।
সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, নতুন জারিকৃত এ সার্কুলারে যে সব পরিমার্জন ও পরিবর্ধন আনা হয়েছে তা সম্ভাবনাময় এ খাতের অর্থায়ন সুবিধা প্রাপ্তির পথ সহজ করার পাশাপাশি এ খাতের কার্যকর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।