
রাজশাহীর নারীরা নকশিকাঁথা সেলাই করে আয় করছেন। অনেকেই ঘরে বসে কাজ করছেন। কেউ হয়েছেন উদ্যোক্তা। তৈরি করছেন কর্মসংস্থান। চাহিদা বাড়ায় তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। রপ্তানিও হচ্ছে বিদেশে। পুরোনো কাপড় দিয়ে তৈরি এসব কাঁথা এখন মূল্যবান পণ্য। কম খরচে লাভ বেশি। শিল্পটি নারীদের স্বপ্ন পূরণ করছে। নিজেকে বদলাচ্ছেন তারা। বংশপরম্পরার এই হস্তশিল্প এখন হচ্ছে সমৃদ্ধ কুটির শিল্প। সরকারি সহায়তা পেলে সম্ভাবনা আরও বাড়বে।
রাজশাহী বিভাগের নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার যোগীপাড়া গ্রামের ৫৪ বছর বয়সী শাহনাজ খাতুন দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ২০১৯ সালে মাত্র ১ হাজার ৭০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। আরডিএ মার্কেটের একটি বুটিক দোকানে মেশিনে সেলাই করা কাঁথা দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন। এরপর নিজ গ্রামে ফিরে মেশিনেই কাঁথা তৈরি শুরু করেন।
বর্তমানে তিনি বাড়িতে বসেই অর্ডার অনুযায়ী কাজ পান। মাসে আয় করেন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। শাহনাজ বলেন, ‘একটি কাঁথা ডিজাইন ও সেলাই করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে।’ তার এই উদ্যোগ অনেক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।
শাহনাজের মতো অনেক নারী এখন কাঁথা সেলাইকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প তাদের জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। বহু দরিদ্র নারী কাঁথা সেলাই করে দারিদ্র্য দূর করে স্বপ্ন পূরণ করছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কাকনহাটের দীনেশ হাসদা ২০১৩ সালে ‘আদিবাসী শান্তা কাঁথা’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় ২৫০ জন নারীকে কাঁথা সেলাইয়ের জন্য নিয়োগ দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাপড় ও সুতা আমি সরবরাহ করি। আকারভেদে প্রতি কাঁথার জন্য নারীদের ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক দিই।’ তার প্রতিষ্ঠান মাসে প্রায় ১ হাজার নকশি কাঁথা তৈরি করে। দীনেশ নিজেই ডিজাইন করে তা পৌঁছে দেন সেলাইকারদের কাছে। তিনি জানান, আমাদের তৈরি কাঁথা এখন ঢাকার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘প্রকৃতি বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে প্রায় ১৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দীনেশ বলেন, ‘আমার প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল এক লাখ টাকা। বর্তমানে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টাকার কাঁথা বিক্রি হচ্ছে।’
গোদাগাড়ীর সোরসোনিপাড়া গ্রামের ৪৮ বছর বয়সী গৃহিণী শিউলি বাসকো বলেন, ‘এই এলাকার মানুষ নকশিকাঁথার দক্ষতার জন্য পরিচিত।’ একই এলাকার ৪৬ বছর বয়সী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমাদের শৈল্পিক ঐতিহ্য থেকে প্রচুর আয় করা সম্ভব।’ তিনি আরও জানান, এলাকার অন্যান্য নারীদের অনুপ্রেরণায় তিনি এই কাজে যুক্ত হন। নিজেই কাজ করার পাশাপাশি কয়েকজনকে সমন্বয় করেন। মাসে আয় করেন প্রায় ৩ হাজার ৮০০ টাকা।
কাকনহাটের ৩৫ বছর বয়সী আদিবা খাতুন বলেন, ‘নকশার ওপর নির্ভর করে একটি কাঁথা তৈরি করতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে।’ তিনি প্রায় এক দশক ধরে এই শিল্পে যুক্ত। আদিবা বলেন, ‘নকশিকাঁথা তৈরিতে খরচ কম, তবে সুচিকর্ম ও সময় সাপেক্ষতা এটিকে মূল্যবান করে তোলে।’ মাঝারি আকারের একটি কাঁথা তৈরি করতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ মাস, যার দাম পড়ে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘পুরোনো কাপড় সহজে পাওয়া যায় বলে লাভের পরিমাণও ভালো।’
এই শিল্পে নারীদের যুক্ত করে সফল হয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের তাহারিমা বেগম লাকি। তিনি ‘নূর নকশি’ নামে একটি সংস্থা পরিচালনা করেন। পুরোনো কাপড় দিয়ে তারা নানান ডিজাইনের নকশিকাঁথা তৈরি করেন। যেটা দেশ-বিদেশে বিক্রি হয়। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১ হাজার নারীকে এই কাজে যুক্ত করে তাদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করেছি।’ বর্তমানে ‘নূর নকশি’তে কাজ করছেন প্রায় ২ হাজার ২০০ নারী। তাদের বেশির ভাগই প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত। তাহারিমা জানান, কোম্পানির ২০ জন কমিশনপ্রাপ্ত এজেন্ট কর্মীদের কাছে সুঁই-সুতা, কাপড় ও ডিজাইন পৌঁছে দেন। কাজ শেষে সেই অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয়। তার বলেন, এই উদ্যোগ নারীদের আর্থিকভাবে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ছাড়াও আমানুরা, শিবগঞ্জ, রানীহাটি, মহিষালবাড়ি, রহনপুর ও গোদাগাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে এই উদ্যোগের কর্মী। সূত্র: বাসস