
সুদের হার বৃদ্ধিসহ বেশকিছু সুবিধা বাড়ানোযর ফলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। এ সময় সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন বিনিয়োগ না হলেও ভাঙানোর প্রবণতা কমায় নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় এসেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সর্বশেষ এপ্রিল মাসে তার আগের মাসের চেয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। তবে মোট বিক্রি কমলেও আলোচ্য মাসে সঞ্চয়পত্র নগদায়ন (ভাঙানো) কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। ফলে এপ্রিলে নিট বিক্রি তথা বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। মার্চেও নিট বিক্রি ইতিবাচক ছিল প্রায় ৮০ কোটি টাকা। এর আগে টানা পাঁচ মাস নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। এ কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের হিসাবে (জুলাই-এপ্রিল) নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, আলোচ্য সময়ে সার্বিকভাবে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর চাপ বেশি ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে অধিকাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় তাদের পক্ষে নতুন করে সঞ্চয় বা বিনিয়োগ কোনোটাই করার সামর্থ্য নেই। এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের পর ধনীরা সঞ্চয়পত্র থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন। এসব কারণে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রিতে ধীরগতি চলছে। তবে গত জানুয়ারি থেকে সুদহার বৃদ্ধিসহ কিছু সুবিধা বাড়ানোয় নির্দিষ্ট সময়ের আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা কিছুটা কমে এসেছে। এ কারণে দুই মাস ধরে (মার্চ ও এপ্রিল) নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।
সুদহার বাড়ানো ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ে সব সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা চালু করা হয়েছে। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবের পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা ফের চালু করা হয়েছে। ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিনিয়োগসীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা তিন মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে আগামী অর্থবছর থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর শর্ত শিথিল করেছে বর্তমান সরকার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে বিনিয়োগ, মজুরি এবং শ্রমবাজার কোথাও খুব বেশি সুখবর নেই। শুধু রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি বাদে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির কোনো খাতেই আয় বাড়ছে না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিও চড়া। অর্থাৎ মানুষের আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে। এই অবস্থায় নতুন করে সঞ্চয় করার মতো সক্ষমতা অধিকাংশ মানুষেরই নেই। তবে সুদহার বাড়ানোসহ বেশকিছু সুবিধা বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। যে কারণে নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।’
এমন বাস্তবতায় সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার সঞ্চয়পত্রে যে সংস্কার করেছে, সেটি মূলত সুদহার বাজারভিত্তিক করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সুদহার বাড়ানোর জন্য নয়। কারণ সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ না নিতে আইএমএফেরও পরামর্শ রয়েছে।’
জানা গেছে, মূলত আইএমএফের পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারিত হবে। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়বে। আর ট্রেজারি বিলের সুদহার কমলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমবে। বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের যে ঋণচুক্তি রয়েছে সেখানেও সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানোর পরামর্শ রয়েছে। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি হিসেবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ করে, সঞ্চয়পত্রেন থেকে তার এক চতুর্থাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবে না। সেই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করতে হবে।
জানা যায়, সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ সরকারের ঋণ হিসেবে গণ্য হয়। এটা বাজেট ঘাটতির অর্থায়নে ব্যবহার করে সরকার। নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার ৭৭০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। একই মাসে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তি এবং মেয়াদ শেষের আগে ভাঙানো বাবদ তুলে নেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৫১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ফলে আলোচ্য মাসে নিট বিক্রি বা বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১ হাজার ২৫৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আগের মাস মার্চে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১৯৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ওই মাসে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। ফলে নিট বিনিয়োগ আসে ৮০ কোটি টাকা।
এর আগে গত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি ছিল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৫৫ হাজার ৯৯১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৪২৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ফলে ১০ মাসে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক রয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৪৩১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা কম থাকায় নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ছিল।
সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড ও আমানতের সুদ বাড়ার কারণে গত জানুয়ারি থেকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়িয়েছে সরকার। বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফার হার বাড়িয়ে করা হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে এই মুনাফা ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখন থেকে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফা মিলবে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার হবে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে এই সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদপূর্তিতে মুনাফার হার হবে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে এত দিন মেয়াদপূর্তির বছরে মুনাফার হার ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এখন এই সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার হবে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই মুনাফার হার হবে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর বাইরে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফার হার বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ।