দেশে ব্যবসারত বিমা কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ সমস্যা নিরসনে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রবিধানমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হতে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের (এনএসআই) এক চিঠির জবাবে এমনটিই জানিয়েছে আইডিআরএ।
আইডিআরএ নিবন্ধন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. নূরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হতে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল সেখানে তিনটি জীবন বিমা কোম্পানি ও ২টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানির সিইও নিয়োগে জটিলতার বিষয়ে বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে মোট ১৯টি কোম্পানি বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব নাজমা মোবারেকের কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়। যা আইডিআরএ-তেও পাঠানো হয়। চিঠিতে পাঁচ বিমা কোম্পানি আইন ভেঙে সিইওর চলতি দায়িত্ব পালন করছে উল্লেখ করে আইডিআরএ কর্তৃক পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এই প্রতিবেদনের পরামর্শের আলোকে আইডিআরএ পরবর্তী সময়ে কি ব্যবস্থা নিয়েছে তাও জানাতে বলা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে চিঠির জবাবে আইডিআরএ জানিয়েছে, বিদ্যমান বিমা কোম্পানি (মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ) প্রবিধানমালা, ২০১২ তে কোম্পানিগুলোতে সিইও নিয়োগের জন্য যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে তা পরিপালন করে প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এ সমস্যা সমাধানে প্রবিধানমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ইতোমধ্যে খসড়া প্রস্তুত আকারে মতামতের জন্য আইডিআরএ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করে ভারপ্রাপ্ত সিইওর মাধ্যমে যেসব কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে সেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো, জরিমানা আরোপ ও রিট মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে চিঠির জবাবে উল্লেখ করেছে আইডিআরএ।
কোম্পানিগুলোত সিইও নিয়োগের জটিলতা নিরসনে গত ১০ জুলাই বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সঙ্গে একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সংস্থাটির চেয়ারম্যানও স্বীকার করেছেন কোম্পানিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বিমা খাতে সিইও সংকট তৈরি করে রেখেছেন।
প্রবিধানমালা সংশোধানের বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে সিইও নিয়োগের জন্য এ সেক্টেরে সিইও সংকট তৈরি করে রাখেন। আইন অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির সিইও হতে হলে এর পূর্ববতী নিম্ন পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই নিম্নপদে কাউকে নিয়োগ প্রদান করেন না। ফলে সিইও সংকট থাকায় কোম্পানিগুলো ভারপ্রাপ্ত সিইও এর মাধ্যমে পরিচালনা করে আসছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিমা খাতের সিইও সমস্যা সমাধানে সংশোধিত প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে বিমা কোম্পানিতে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা আর এএমডি হিসেবে এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে সিইও হিসেবে আবেদন করা যাবে। এ ছাড়া কারও বিমা কোম্পানিতে তিন বছরের ডিএমডিসহ ১ বছর সদর দপ্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও তিনি সিইও হতে পারবেন। তবে তার বিমা কোম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাগবে ১২ বছর। ১৫ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাসহ তিন বছরের ডিএমডি ও এক বছরের এএমডি থাকলেও বিমা কোম্পানির সিইও হিসেবে আবেদন করা যাবে।’
চলতি বছরের ৭ মার্চ আইডিআরএ এক চিঠিতে জানিয়েছে, কোনো বিমা কোম্পানিতে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব)’ হিসেবে কাউকে নিয়োগ করা যাবে না। কোনো কোম্পানিতে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব)’ পদবি কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ প্রস্তাব আইডিআরএর অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসরণ করে একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া যাবে।
আইডিআরএ পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, সোনালী লাইফ কোম্পানিটিতে ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিল প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কোম্পানির মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে ১১টি রিট মামলা করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি প্রশাসকের পদত্যাগ গৃহীত হলে কোম্পানিটিকে সিইও নিয়োগের জন্য আইডিআরএ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়। গত ২৫ মে কোম্পানিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিইও নিয়োগ চার মাস সময় প্রদানের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি শেখ আব্দুল রশিদকে সিইও হিসাবে নিয়োগের জন্য আইডিআরএতে আবেদন করেছে। আইডিআরএ পক্ষ থেকে কোম্পানির হালনাগাদ চেক লিস্ট অনুযায়ী পুনঃনিয়োগ প্রস্তাব দাখিলের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোম্পানির সিইও পদ ছয় মাসের বেশি সময় শূন্য থাকায় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর মোশাররফ হোসেনকে সিইও নিয়োগের আবেদন করলে আইডিআরএ থেকে তার অব্যবহিত নিম্নপদে থাকার প্রত্যয়পত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যা এখনো প্রক্রিয়াধীন।
রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ না হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোম্পানিটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও কোম্পানিটিতে এখনো সিইও নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়নি। সর্বশেষ গত ২৫ মে কোম্পাটির প্রস্তাবিত সিইওর বিষয়ে আইডিআরএর কাছে রিভিউ আবেদন করে এবং ১৭ জুন আইডিআরএ- কোম্পানির নতুন চেকলিস্ট অনুযায়ী পুনরায় আবেদনের জন্য জানিয়েছে।
এ বিষয়ে আইডিআরএর মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিমা কোম্পানিতে সিইও নিয়োগের প্রবিধানমালা সংশোধনে ইতোমধ্যে এ খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আইডিআরএ- এ বিষয়ে খুবই সচেতন।’