
এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে দুই থেকে ছয় টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। অনেকের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি এখন বিলাসীপণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোক্তার অধিকার নিয়ে করা সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকারকে এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কেন চালের দাম ‘অস্বাভাবিক হারে’ বাড়ছে? এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে খবরের কাগজ।
কথা হয় খাতুনগঞ্জের চাক্তাই ও পাহাড়তলীর চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তারা দাম বাড়ার তিনটি কারণ সামনে এনেছেন। তাদের ভাষ্য, প্রথমত উত্তরবঙ্গে মিলারদের একটি শক্তশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, পরিবহন খরচ ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। তৃতীয়ত, বড় বড় শিল্প কারখানা ধান মজুত করে ফেলেছে। এসব কারণে বর্তমানে প্রতিমণ ধান ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।
এদিকে চালের আড়তদার ও অধিকারকর্মীদের অভিযোগ, বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারও চালের সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সুষ্ঠু বাজার তদারকির ব্যবস্থা নেই। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
চালের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেজিতে ২ টাকা বেড়ে জিরাশাইল ৭২ টাকা, স্বর্ণা সেদ্ধ চাল ৬২ টাকা ও নাজিরশাইল সেদ্ধ ৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে পাইজাম চাল ৮২ টাকা, কাটারিভোগ ৭৮ টাকা ও পাইজাম সেদ্ধ ৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে মিনিকেট আতপ ৭৮ টাকা ও কেজিতে ৬ টাকা বেড়ে মোটা সেদ্ধ চাল ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি পাইকারিতে প্রতিকেজি চিনিগুঁড়া চাল বিক্রি হচ্ছে ১১৬ টাকায়।
পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেছেন, ‘উত্তরবঙ্গের মিলাররা শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি করে চালের দাম বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি এসব জায়গা থেকে আগে চাল আনতে ট্রাকপ্রতি ভাড়া ছিল ২২ হাজার টাকা, বর্তমানে গুনতে হচ্ছে ৩২ হাজার টাকা। এর প্রভাবও চালের বাজারে পড়েছে।’
চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ে চালের দাম বাড়ার কথা না। কিন্তু এবার আমরা উল্টো চিত্র দেখতে পাচ্ছি। মূলত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ ও যথাযথ বাজার তদারকি ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তার ওপর বড় শিল্পগ্রুপগুলো প্রচুর পরিমাণে ধান মজুত করেছে। এ কারণে প্রতিমণ ধান ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়িয়েছে। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে।’
চট্টগ্রাম চালকল সমিতির সভাপতি হাজি ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের বাজার চড়া করছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, রাজশাহী বিভাগের মিলগুলোকে এখন থেকে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। সরকারের উচিত তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা। অন্যথায় চালের বাজারদর আরও বেড়ে যাবে।’
এদিকে চালের বাজার দর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করেছে চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজ। মানববন্ধনে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি), কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম, ও আইএসডিই বাংলাদেশ নামক এনজিও অংশ নেয়।
বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের (খানি) সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বলেন, ‘মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষ ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। অথচ চালের দাম বাড়ায় তা কিনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। দাম বাড়ায় নিম্নআয়ের মানুষ মাছ, মাংস, ডাল বা সবজিও ঠিকমতো কিনতে পারছেন না। এ কারণে দিনে দিনে পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।’
ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, ‘মিল মালিকদের মজুতদারি, করপোরেট সিন্ডিকেট এবং যথাযথ বাজার তদারকি না থাকায় চালের বাজারে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। চালের বাজারে যথাযথ তদারকি ব্যবস্থা না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। আর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রতিকেজি চালে ৮-১০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চাল এখন বিলাসীপণ্য হয়ে গেছে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেছেন, ‘আমাদের বাজার তদারকি চলমান রয়েছে। আমরা খাতুনগঞ্জের চাক্তাই ও পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালিয়েছি। সেখানকার ব্যবসায়ীদের ভাউচার যাচাই করেছি। তাদের কেনা খরচ বেশি পড়ছে। পাশাপাশি বাড়তি পরিবহন খরচও গুনতে হচ্ছে। বিষয়গুলো আমরা ঢাকায় জানিয়েছি। কিন্তু এই অজুহাতে তারা বাড়তি অর্থ যাতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করতে না পারে সেটা আমরা নজরদারিতে রেখেছি।