দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তৈরি পোশাকশিল্পে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গত তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ কার্যাদেশ হাতছাড়া হয়েছে এ খাতে। পোশাকশিল্পের অস্থিরতার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও। চট্টগ্রাম, গাজীপুর, আশুলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষের জেরে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান এই খাত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের শুল্কমুক্ত প্রবেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি পুনর্বহাল না হওয়ায় পোশাকশিল্পের কার্যাদেশ চলে যাচ্ছে ভারত ও ভিয়েতনামে। গত তিন মাসে নানা ঘটনায় সরবরাহ চেইনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা। দেশে অস্থিরতা ও শ্রমিকদের আন্দোলনে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এতে পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে বায়ারদের কাছে। ফলে হাতছাড়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ কার্যাদেশ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত তিন মাসে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকের কার্যাদেশ ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রতিবেশী দেশে চলে গেছে। এ অবস্থায় রপ্তানি কমার পাশাপাশি দীর্ঘদিন প্রণোদনার টাকা আটকে থাকায় তারল্য সংকটে পড়েছেন পোশাক কারখানার মালিকরা। সংকট কাটাতে বেতন-ভাতা পরিশোধে স্বল্প সুদে ঋণ এবং এই খাতকে স্থিতিশীল রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রোডম্যাপ চান পোশাকশিল্পের মালিকরা। উদ্যোক্তাদের অনুমান, চলমান অস্থিতিশীলতায় অন্তত ২০ শতাংশ রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক ক্রেতা প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসছেন না। এ ছাড়া জিএসপি পুনর্বহালসহ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার সমস্যাটিও সুরাহা হয়নি এখনো। এতে বৈরী প্রভাব পড়েছে পোশাক খাতে। গত ৪০ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প। যদিও বৈশ্বিক মন্দার ক্রয়াদেশ ও পোশাকের দাম কমে যাওয়াসহ তিন বছর ধরে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এই খাত। সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থান ও বন্যায় আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন দেশের রপ্তানিকারকরা। রপ্তানি কমায় মধ্যম সারির পোশাক কারখানাগুলো হলিডে সিজনের প্রত্যাশিত ক্রয়াদেশ পাচ্ছে না। এতে চরম সংকটে পড়েছে কারখানাগুলো।
এলসি খোলাসহ নানা বিষয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। ক্রয়াদেশগুলো কেন অন্য দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। বিজিএমইএর নেতারা বলছেন, সরকার পোশাক কারখানাগুলোকে এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদ দাবি করায় তা কোনো কাজে আসছে না বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এখানে কম সুদে ব্যাংকঋণ চান মালিকরা।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। কিছু কারখানার শ্রমিক অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছে। সড়ক অবরোধ করছে, কারখানা ভাঙচুর করছে। এগুলো বিদেশি বায়ারদের কাছে বিরূপ প্রভাব পড়ে। কার্যাদেশ অন্য দেশে চলে যায়। নিরাপত্তাজনিত কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয় বিদেশিরা। ফলে আমাদের দেশ থেকে পোশাকশিল্পের কার্যাদেশ চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। বিশেষ করে ভারত, ভিয়েতনাম, পাকিস্তানের মতো দেশে যাচ্ছে পোশাকের কার্যাদেশ।
রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পোশাকশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ সেই শিল্পের অস্থিরতা থামছেই না। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলনের ফলে শিল্পাঞ্চল হঠাৎ উৎপাদনবিমুখ হয়ে পড়েছে। হামলা-ভাঙচুরের ফলে বাধ্য হয়ে কারখানার মালিকদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ওপর পড়ছে। তাই পোশাকশিল্পের কাজের পরিবেশ ফেরাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিল্পোদ্যোক্তাদের শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার সফল হবে, সেটাই প্রত্যাশা।