ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রশাসনে স্থবিরতা সংকট কাটিয়ে গতিশীলতা আনতে হবে

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪১ এএম
প্রশাসনে স্থবিরতা
সংকট কাটিয়ে গতিশীলতা আনতে হবে

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রেই অস্থিরতা বিরাজমান। স্বাভাবিক কাজের গতি মন্থর হয়ে আছে। প্রশাসনের বড় বড় সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণে তৎপরতা নেই। শুধু রুটিন কাজগুলো চলছে। প্রশাসনের শীর্ষ পদে নিয়মিত কর্মকর্তার (ইন ওয়ার্ক) পদে হঠাৎ অনিয়মিত কর্মকর্তার (অফ ওয়ার্ক) নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন, প্রশাসন ও বিভাগের কাজ সমাপ্ত করতে সময় নষ্ট হচ্ছে। প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছে ধীরগতিতে। ইন ওয়ার্কে যেসব কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের নিয়মিত প্র্যাকটিস থাকায় অনেক কিছু সহজেই বুঝে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। আর এখন অনেক সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব আছেন, যারা অনেক দিন প্রশাসনের কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন না। 

কয়েক বছর বা বেশ কিছু সময় তারা প্রশাসন থেকে বাইরে অর্থাৎ অফ ওয়ার্কে ছিলেন। তাই এসব কর্মকর্তার কাজ বুঝতে সময় লাগছে। তবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে প্রশাসনের কর্মকাণ্ড। সূত্রমতে, চলতি সপ্তাহে স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সচিব এবং আট জেলায় ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। ফলে প্রশাসনে আরও কিছু পরিবর্তন আসছে। কিছুদিন ধরে সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শূন্য রয়েছে। অতিরিক্ত সচিবরাই সেখানে রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসেও দেখা গেছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে বঞ্চিত ও পদোন্নতিপ্রত্যাশী কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কয়েকটি জেলায় ডিসি নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। যা পরবর্তী সময়ে বাতিল করতে হয়। এসব জেলায় এখনো ডিসি নিয়োগ না হওয়ায় সেখানে মাঠ প্রশাসনে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এর পরও যোগ্য কর্মকর্তাদের (উপসচিব) যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ডিসি নিয়োগের কাজ করছে সরকার। পাশাপাশি সচিব পদেও নিয়োগ নিয়ে কাজ চলছে।

গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সচিব পদে বড় ধরনের রদবদল আনা হয়। বিগত সরকারের সময় প্রশাসনে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এটি নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে নেতিবাচকভাবেই দেখা হয়। বর্তমান সরকারের আমলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, অতীতের সরকারগুলোর পথেই হাঁটছে এ সরকার। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সরকারের শেষ সময়ে প্রশাসনে দুই শীর্ষ পদসহ অন্তত ২৪টি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ছিলেন অবসরে যাওয়া সাবেক আমলারা। এ নিয়ে প্রশাসনে অস্বস্তি তৈরি হয়। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক দিনেই ১১ জন সচিবের চুক্তি বাতিল করে। পরে আরও বেশ কিছু চুক্তি বাতিল করা হয়। এর পর বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় প্রশাসনে।

প্রশাসনের উচ্চপদগুলোয় অধিকতর যোগ্য, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করে পদায়ন করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর পথ তৈরি করতে হবে। বর্তমানে প্রশাসনের সামগ্রিক উন্নয়নকাজে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সেই স্থবির অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনকে গতিশীল করতে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

টিআইবির প্রতিবেদন  সেবা খাতে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করুন

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ এএম
টিআইবির প্রতিবেদন 
সেবা খাতে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করুন

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২৩ অনুষ্ঠানে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে টিআইবি জানিয়েছে, বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেবা খাতসমূহ।

 শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, ভূমি, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক খাতসহ ১৭টি সুনির্দিষ্ট খাতের ওপর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে গিয়ে সেবাগ্রহীতা কী ধরনের দুর্নীতির শিকার হন, তা পরিমাপ করতে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। ২০২৩ সালের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে প্রস্তুতকৃত দুর্নীতিবিষয়ক জরিপে আরও জানা যায়, এই সময়ে সর্বোচ্চ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ে বিচারিক সেবা, বিমা ও ভূমিসেবা খাতসমূহ শীর্ষে ছিল। 

প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা (পরিবার) এবং ঘুষের শিকার ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার। সেই সঙ্গে সার্বিকভাবে পরিবারগুলো গড়ে ৫ হাজার ৬৮০ টাকা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে গড় ঘুষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বিচারিকসেবা, ভূমিসেবা ও ব্যাংকিং খাতে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সেবা খাতে জাতীয় পর্যায়ে মোট ঘুষের ন্যূনতম প্রাক্কলিত পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। 

জরিপে উঠে এসেছে, গ্রামাঞ্চলের পরিবারের তুলনায় শহরাঞ্চলের পরিবারগুলোকে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে এবং সেবা দিতে গিয়ে উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের পরিবার তাদের বার্ষিক আয়ের অপেক্ষাকৃত বেশি অংশ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। এটা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত বোঝার সৃষ্টি করেছে, যা বিগত সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্বলতা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। 

নারী সেবাগ্রহীতাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি দুর্নীতির শিকার হওয়ার ফলে এসব খাতে নারীদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করছে। এতে নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে সকল পর্যায়ে দুর্নীতি ও ঘুষ কমিয়ে আনার অঙ্গীকার পূরণে সেবা খাতে দ্রুত কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো- সেবা খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, সেবা পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা, সেবা খাতে হয়রানি বন্ধে গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস) ও অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা এবং অভিযোগগুলো নিয়মিত পর্যালোচনা করে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতার মতামত নেওয়া। বিশেষ করে সেবা খাতের জন্য যুগোপযোগী আচরণবিধি প্রণয়ন। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানি ও সামাজিক নিরীক্ষা চালুর বিষয় উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করার সুপারিশ করেছে টিআইবি।

টিআইবি ১৭টি সুনির্দিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সেবা খাতের ওপর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। সুপারিশগুলোর যথার্থতা মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেবা খাতে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধে সেবাগ্রহীতার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি  অচলাবস্থা কাটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ এএম
শিক্ষায় অপূরণীয় ক্ষতি 
অচলাবস্থা কাটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন

দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আবার কখনো মানবসৃষ্ট কারণে শিক্ষায় ধাক্কা লাগছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষার্থীদের মনোজগতে পরিবর্তন, পাঠ্যসূচিতে সংযোজন-বিয়োজন, পরীক্ষা না দেওয়ার প্রবণতা, উচ্চশিক্ষায় সেশনজট, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পাবলিক পরীক্ষা, অটোপাসসহ নানা কারণে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২০ সালে মহামারি করোনায় ব্যাহত হয় প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর পড়ালেখা। ধাপে ধাপে এই অচলাবস্থা কাটানোর চেষ্টা হলেও করোনার ক্ষতিকর প্রভাব এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনের কারণে শিক্ষায় ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত জেলাগুলোর শিক্ষা খাতে দেখা দিয়েছে বিপর্যস্ত অবস্থা। সেশনজটের কবলে পড়ে শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়েছে অনেকের। 

তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ মার্চ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংক্রমণ বাড়লে পর্যায়ক্রমে বাড়ে ছুটিও। সব মিলিয়ে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ ছিল সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মৌলিক সাক্ষরতা এবং গাণিতিক দক্ষতার ঘাটতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। বিশ্লেষকদের মতে, মহামারির বহুমাত্রিক প্রভাবের মধ্যে শিখন ঘাটতি এবং শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার উচ্চহার ছিল ব্যাপক। 

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়, ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি ও ৬৯ শতাংশ গণিতের প্রত্যাশিত দক্ষতার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কারিকুলাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগ বিভাজন চালু করা হবে বলে জানানো হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালের নবম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য দশম শ্রেণিতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস চালুর কথা উল্লেখ করা হয়। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটি অংশ সমালোচনা করছেন। তাদের দাবি, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন দরকার। 

ঝরে পড়ার পাশাপাশি সেশনজটের কবলে পড়ে শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়েছে অনেকের। কর্মসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনের কারণেও প্রায় এক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নির্ধারিত পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। এই আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে পরিবর্তন এসেছে। নানা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় একটা অংশের মধ্যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হেনস্তার ঘটনাও ঘটে। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এস এম ফায়েজ খবরের কাগজকে বলেন, ছাত্র-শিক্ষকদের ঘাটতি পূরণে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এই ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। 

বিভিন্ন কারণে দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা দূর করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, এ কথা মাথায় রেখেই সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থাকে আনন্দপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। আশা করছি, অন্তর্বর্তী সরকার সাম্প্রতিক সময়ের অচলাবস্থা দূর করে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নিন

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন
বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নিন

৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এই সম্পর্ক কীভাবে স্বাভাবিক হবে, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তবে এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। দিন শেষে দুই দেশের সম্পর্কের কালো মেঘ কেটে যাবে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা ও দিল্লির পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। কূটনীতিকদের মতে, উভয় দেশের পারস্পরিক প্রয়োজনেই এই সম্পর্ককে স্বাভাবিক করা দরকার। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে একের পর এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এই সংকটকে ক্রমেই অবিশ্বাস আর অনাস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 

মাঝখানে তৃতীয় পক্ষও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বহির্বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশেরে সহকারী হাইকমিশনে গত সোমবার হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। 

এই হামলার ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে দুঃখ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরকে ছাড়া চলা কঠিন। এ অবস্থায় দুই দেশের জনগণের মধ্যেও অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। দুই দেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হচ্ছে না। এতে জল আরও ঘোলা হচ্ছে। জনগণের পারস্পরিক মেলবন্ধন ও দীর্ঘদিনের যে ঐতিহ্য রয়েছে, তাতেও এর প্রভাব পড়ছে। 

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের এই জটিল সমীকরণের মধ্যেই এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় শুরু হচ্ছে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক। এই বৈঠকে কিছুটা আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। বৈঠকে অনেক সমস্যার কথা উঠে আসবে এবং ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। এতে পারস্পরিক আস্থা আরও বাড়বে, যা আগামী দিনে এই সম্পর্ককে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনবে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে রদবদল হয়েছে। এক কথায় দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই এখন ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ নীতিতে চলছে ভারত। 

কূটনীতিকরা বলছেন, দুই সরকারের বাইরে থেকে নানা ধরনের অপপ্রচার ও পরস্পরবিরোধী উসকানি আসছে, যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলছে। যদিও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক উদ্যোগের যথেষ্ট দক্ষতা ও পেশাদারির অভাব আছে। সম্পর্কোন্নয়নের কূটকৌশলে অনেক ধরনের উপায় আছে। কাজেই কোনটি এখন দরকার এবং কীভাবে উত্তেজনা কমিয়ে এনে পারস্পরিক আস্থা তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আঞ্চলিক সংস্থা সার্ককে কার্যকর করতে চান। এ ক্ষেত্রে ভারতও সার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ফলে সার্ককে কার্যকর করতে হলে ভারতকে সঙ্গে রাখতে হবে। সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতে সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর খবরের কাগজকে বলেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। এই মুহূর্তে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা ভারতকে সম্মান করি, তাদের উচিত বাংলাদেশকে সম্মান জানানো। পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা বুঝতে হবে। দুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করলে সম্পর্কে বাধা আসবেই। তবে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে যে বৈঠক হতে যাচ্ছে, তাতে উত্তেজনা কমতে পারে। এ ধরনের আলোচনা ঘন ঘন চলতে থাকলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। 

ভারত নিকটতম প্রতিবেশী বৃহত্তর একটি দেশ। এ দেশের স্বাধীনতায় ভারতের অবদানের কথা বিবেচনায় রেখেই সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতকেও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কাজেই দুই দেশের সম্পর্ক সমমর্যাদার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাই হোক সম্পর্কের মূল ভিত্তি।

 

দুর্নীতির শ্বেতপত্র পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনুন

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
দুর্নীতির শ্বেতপত্র
পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনুন

যেকোনো দেশের মূল প্রাণপ্রবাহ হচ্ছে তার অর্থনীতি। জীবন-জীবিকার এই প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে গেলে দেশ হয়ে পড়ে রক্তশূন্য। জনজীবন ও রাষ্ট্রে নেমে আসে বিপর্যয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে এমনটিই ঘটেছে। গত রবিবার অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এ তথ্য। ৩৯৭ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে সব মিলিয়ে ২২টি ক্ষেত্রের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি হস্তান্তরের মুহূর্তে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই সময়ে পাচার হয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে ২৮ লাখ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত কুশীলবরা এ কাজটি করেছেন। গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির ভয়াবহ চক্র। পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম হয়েছে অলিগার্কদের। তাদের লুণ্ঠন, লুটপাট ও পাচার এমন মাত্রায় ঘটেছে যে প্রধান উপদেষ্টা সেটা জেনে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

খবরের কাগজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল প্রকল্পের সঙ্গে অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে, কেনার ক্ষেত্রে হেরফের করে এবং কর অব্যাহতি দিয়ে ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত এই ব্যয়ের ৪০ শতাংশ অর্থ লুটপাট করেছেন আমলারা। অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ অসৎ রাজনীতিবিদ ও মধ্যস্থতাকারী ব্যবস্থাপক বা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার ক্রীড়নকরা আত্মসাৎ করেছেন। তারা এই অর্থের প্রায় সবটাই পাচার করেছেন বিদেশে। প্রতিবেদনে হিসাব করে দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার করা অর্থ দিয়ে বিদেশে কেনা হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি এবং বিনিয়োগ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়। পাচারের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বেশ কিছু ছোট দেশে পাচারকারীরা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সাম্রাজ্য। 

পাচারের এই ভয়াবহ চিত্রটি শুধু লুটপাট নয়, আরও বেশ কিছু বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে আসে। যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের কাছে দেশ বা দেশপ্রেম কখনো গুরুত্ব পাননি। নীতি-নৈতিকতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পরিবার তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধও তারা করেছেন। নিজের দেশকে সম্পদশূন্য করার এই প্রবণতা একদিকে যেমন বেআইনি, অমানবিক; তেমনি উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। উন্নয়নের যে প্রচার দেখা গেছে, তা ছিল আসলে ‘ওপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ ধরনের মতো বিষয় অর্থাৎ আইওয়াশ। প্রতিবেদনের আরেকটি যে দিক আমাদের নজরে এসেছে তাও মারাত্মক। বিদেশি ঋণ যত এসেছে তার দ্বিগুণ পাচার হয়ে গেছে। একেবারে সাদা চোখে দেখলেও বোঝা যায়, এভাবে অর্থ পাচারের ফলে বাংলাদেশ নানা দিক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু কর অব্যাহতির পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ করা যেত। অথচ এই খাতগুলো ধুঁকছে। 

এই প্রেক্ষাপটে এখন আমাদের কী করণীয়, সেটা বিলক্ষণ বোঝা যায়। পাচারের যে চক্র গড়ে উঠেছিল, ভবিষ্যতে সেটা আর দেখতে চাই না। যেকোনো উপায়ে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। আর কিছু না হোক, ফিরিয়ে আনার আন্তরিক উদ্যোগটুকু আমরা দেখতে চাই। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা গেলে রক্তশূন্যতায় কঙ্কাল হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে প্রাণপ্রবাহের সঞ্চার হবে।

মনোবল ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন পুলিশে এখনো আতঙ্ক কেন

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম
পুলিশে এখনো আতঙ্ক কেন

জুলাই আন্দোলনের পর প্রায় চার মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসন করছে। নতুন সরকার এমন একটা সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে, যখন রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে চলছিল একধরনের অস্থিরতা। অস্থিরতা থেকে দেখা দেয় অব্যবস্থাপনা। নতুন কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে এমনটিই হওয়ার কথা। বিশেষ করে সেই সরকার যদি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত কোনো সরকারের স্থলাভিষিক্ত হয়, হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে যায়, তাহলে দেশ শাসন করাটা সহজ হয় না।

অন্তর্বর্তী সরকারকেও এ রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় দেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। যেহেতু মতাদর্শিকভাবে নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ফলে পাল্টে ফেলতে হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের সব অবকাঠামো। বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে হচ্ছে সবকিছু। কিন্তু এটা সহজ কাজ নয়। খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষিত রাখার কাঠামোটি সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে অব্যবস্থাপনার। জুলাই আন্দোলনের অভিঘাতে পুরো পুলিশি ব্যবস্থাই তছনছ হয়ে গেছে। পুলিশের মধ্যেই আলোচনা আছে, চেইন অব কমান্ড বলতে যা বোঝায় সেটা সেভাবে নেই।

অবশ্য আমাদের অজানা নেই আগে কী কারণে এটা ঘটেছে, এখন কেন ঘটছে। প্রতিবেদন থেকেই দেখা যাচ্ছে, পুলিশকে সব সময় পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিগত সরকারের শেষ দিকে এটা চরমে উঠেছিল। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সব ধরনের দমন-পীড়নমূলক কাজ তারা করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে পুলিশ সম্পর্কে জনরোষ তীব্র হয়েছিল। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে থানা আক্রমণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অস্ত্র লুট হয়েছে, হয়েছে পুলিশ হত্যাও। সাম্প্রতিক সংকটের সূত্রপাত ঘটে তখনই। দুই দিক থেকে, অর্থাৎ পুলিশ ও সাধারণ মানুষ, উভয়েরই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পুলিশ এখন জীবনের ভয়ে ভীত। ফলে কোনো অ্যাকশনে যায় না, গেলেও দেরিতে যায় এবং সংঘাত এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরও পুলিশ-ভীতি চলে গেছে। একদিকে সুযোগসন্ধানী মানুষ মব অপরাধের মতো অপরাধ করতে উৎসাহী হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয় থাকছে, অ্যাকশনে গেলেও কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। জীবনের ভয় ছাড়াও একধরনের ‘অনিশ্চয়তা’ তাদের ওপর ভর করেছে।

খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বর্তমান সরকারের আয়ুষ্কাল নিয়ে পুলিশের সংশয় আছে। এ রকম পরিস্থিতিকে তারা সাময়িক আর অস্বাভাবিক মনে করছে। তাদের অপেক্ষা ‘স্বাভাবিক’ সময়ের। বোঝা যায়, পুলিশ দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচিত কোনো সরকারের অপেক্ষায় আছে। বলাবাহুল্য, এটা পুলিশ বাহিনীর ভাষ্য নয়, ব্যক্তিগতভাবে অনেক পুলিশ সদস্য এ রকমটাই মনে করেন। ফলে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে গিয়ে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এর পাশাপাশি সরকারের কিছু ‘অনিবার্য’ সিদ্ধান্তের কারণে পুলিশের কার্যক্রম এখনো সেভাবে গতি পায়নি। বিশেষ করে ঢাকায় আগে যারা কর্মরত ছিলেন, তাদের ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে পুলিশ এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে সরকার। স্বাভাবিকভাবেই নতুন যারা আসছেন তাদের রাজধানীর অপরাধের গতি-প্রকৃতি বুঝতে সময় লাগছে। কিন্তু অপরাধ এমন যে কখনো থেমে থাকে না। সরকার নতুনভাবে পুলিশ বাহিনীকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সরকার সম্ভাব্য সবকিছুই করছে। গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশের মনের ‘ভয়’ দূর করে ‘মনোবল’ ফিরিয়ে আনার। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি সরকারের আরও কিছু করার আছে। 

সরকার বা পুলিশ প্রথমে যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে পারে সেটা হলো- প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা। জুলাই আন্দোলনের পর নাগরিকরা নিজেরাই চুরি-ডাকাতি ঠেকানোর জন্য এ রকম অসংখ্য সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এখন একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, জুলাই আন্দোলনে যেসব তরুণ অংশগ্রহণ করেছিল, সেসব তরুণকে এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে এনে সাময়িকভাবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তিভিত্তিক পদ্ধতি গড়ে তুলে অপরাধ দমন করার পদক্ষেপ নিতে পারে পুলিশ বাহিনী। আধুনিক বিশ্বের বহু দেশে এ রকম পদ্ধতি চালু আছে। প্রয়োজনে এ জন্য অন্য দেশের অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করে কাজে লাগানো যায়। চতুর্থত, পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো জরুরি। অপরাধ দমনকে আসলে ‘কমিউনিটি’ কার্যক্রমের প্রেরণায় দমন ও প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। শুধু এসব নয়, আরও নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুলিশকে সেবামূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলেই আধুনিক জনবান্ধব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বিভাগ গড়ে উঠবে।