প্রসাধন পণ্যে নকলের ভিড়ে আসল চেনা বড় দায়। বাজার এখন নকল প্রসাধনীতে সয়লাব। এত নিখুঁতভাবে নকল প্রসাধনী বাজারজাত করা হয় যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল, ভোক্তার পক্ষে তা আলাদা করা কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে পারলারের রমরমা ব্যবসা চলছে। সেখানে প্রসাধনীর যত্রতত্র ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। শুধু তা-ই নয়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, কিডনি বিকল হওয়া থেকে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি রোগও হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকল প্রসাধনীতে ইচ্ছামতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব রাসায়নিক বেশি মাত্রায় প্রয়োগের ফলে মানবদেহে ক্যানসার, অ্যালার্জি, ত্বকের প্রদাহ, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এসব প্রসাধনীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও মারাত্মক। চলতি বছরের (জানুয়ারি-অক্টোবর) বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিযানে ১৭ কোটি ৩৪ হাজার ৩৯২ টাকার নকল ও মানহীন প্রসাধনী জব্দ করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপনে নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান নকল ও মানহীন প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানে দেখা গেছে, বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর নকল বেশি হচ্ছে। নকল প্রসাধনী ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের আটকও করা হচ্ছে। নকল পণ্য জব্দ করে কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে। নকল প্রসাধনীতে ব্যবহার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক। অনুমোদনহীন ও লেভেলবিহীন অনিরাপদ কাঁচামালের সঙ্গে অ্যাসিড ও অন্যান্য কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় ত্বক ফর্সা করার নকল ক্রিম।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মানহীন প্রসাধনী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মিলেছে সরকারি বিভিন্ন অভিযানে। অভিযানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানায় তাদের নেই কোনো কেমিস্ট। কারখানার ভেতর ছোট একটি ‘ল্যাবরেটরি’ বানিয়ে সেখানে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স না নিয়েই অবৈধভাবে বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করে নকল পণ্য বাজারজাত করছিল আশুলিয়ায় ‘লাবিবা কসমেটিক্স এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নকল প্রসাধনী জব্দ করে কারখানাটি সিলগালা করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পুরান ঢাকার লালবাগের হায়দার বক্স লেনের একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে চলা একটি কারখানায় অভিযান চালানো হয়। এ রকম দেশব্যাপী অসংখ্য নকল প্রসাধনী কারখানা গড়ে উঠেছে। জনগণ সচেতন না হলে এ ধরনের প্রসাধনী কারখানা ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ফার্মেসি অনুষদের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রসাধনীর যে চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ জোগান দিচ্ছে অনুমোদিত দেশীয় কোম্পানি, ২৫ শতাংশ আমদানি করা পণ্য। বাকি ৬০ শতাংশ প্রসাধনী নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে, যার মূল কেন্দ্র পুরান ঢাকা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি সাবেক সচিব গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, প্রসাধনসামগ্রীতে ভেজালের সঙ্গে জড়িতদের বিএসটিআইয়ের আইন অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ কম, নকল প্রসাধনীগুলো সস্তায় পাওয়া যায়। যা কিনে সাধারণ মানুষ যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা জামিনে বেরিয়ে আবারও নকল প্রসাধনীর কারবার করছেন। এর অন্যতম কারণ নকল প্রসাধনী বাজারজাত করতে পারলেই বড় অঙ্কের অর্থ পকেটে আসছে। এসব ব্যক্তির নকল পণ্য বাজারজাত করার নেটওয়ার্ক শক্তিশালী। ফলে উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি রাজধানীসহ সারা দেশের মার্কেটগুলোতেও সহজে বিক্রি করতে পারছে।
নকল প্রসাধনীর উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। মানহীন প্রসাধনী প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধানে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। যে অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করতে হবে, ভোক্তাদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে এ ধরনের মানহীন নকল প্রসাধনী ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসবে। আশা করি, সরকার এই বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবে।