ঢাকা ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
English
বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নকল প্রসাধনী মানহীন প্রসাধনী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ এএম
নকল প্রসাধনী
মানহীন প্রসাধনী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন

প্রসাধন পণ্যে নকলের ভিড়ে আসল চেনা বড় দায়। বাজার এখন নকল প্রসাধনীতে সয়লাব। এত নিখুঁতভাবে নকল প্রসাধনী বাজারজাত করা হয় যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল, ভোক্তার পক্ষে তা আলাদা করা কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে পারলারের রমরমা ব্যবসা চলছে। সেখানে প্রসাধনীর যত্রতত্র ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। শুধু তা-ই নয়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, কিডনি বিকল হওয়া থেকে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি রোগও হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকল প্রসাধনীতে ইচ্ছামতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব রাসায়নিক বেশি মাত্রায় প্রয়োগের ফলে মানবদেহে ক্যানসার, অ্যালার্জি, ত্বকের প্রদাহ, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এসব প্রসাধনীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও মারাত্মক। চলতি বছরের (জানুয়ারি-অক্টোবর) বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিযানে ১৭ কোটি ৩৪ হাজার ৩৯২ টাকার নকল ও মানহীন প্রসাধনী জব্দ করা হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপনে নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান নকল ও মানহীন প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানে দেখা গেছে, বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর নকল বেশি হচ্ছে। নকল প্রসাধনী ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের আটকও করা হচ্ছে। নকল পণ্য জব্দ করে কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হচ্ছে। নকল প্রসাধনীতে ব্যবহার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক। অনুমোদনহীন ও লেভেলবিহীন অনিরাপদ কাঁচামালের সঙ্গে অ্যাসিড ও অন্যান্য কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় ত্বক ফর্সা করার নকল ক্রিম।

দেশের বিভিন্ন স্থানে মানহীন প্রসাধনী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মিলেছে সরকারি বিভিন্ন অভিযানে। অভিযানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানায় তাদের নেই কোনো কেমিস্ট। কারখানার ভেতর ছোট একটি ‘ল্যাবরেটরি’ বানিয়ে সেখানে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে চলছে রমরমা ব্যবসা। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স না নিয়েই অবৈধভাবে বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করে নকল পণ্য বাজারজাত করছিল আশুলিয়ায় ‘লাবিবা কসমেটিক্স এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। নকল প্রসাধনী জব্দ করে কারখানাটি সিলগালা করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পুরান ঢাকার লালবাগের হায়দার বক্স লেনের একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে চলা একটি কারখানায় অভিযান চালানো হয়। এ রকম দেশব্যাপী অসংখ্য নকল প্রসাধনী কারখানা গড়ে উঠেছে। জনগণ সচেতন না হলে এ ধরনের প্রসাধনী কারখানা ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ফার্মেসি অনুষদের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রসাধনীর যে চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ জোগান দিচ্ছে অনুমোদিত দেশীয় কোম্পানি, ২৫ শতাংশ আমদানি করা পণ্য। বাকি ৬০ শতাংশ প্রসাধনী নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে, যার মূল কেন্দ্র পুরান ঢাকা।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি সাবেক সচিব গোলাম রহমান খবরের কাগজকে বলেন, প্রসাধনসামগ্রীতে ভেজালের সঙ্গে জড়িতদের বিএসটিআইয়ের আইন অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ কম, নকল প্রসাধনীগুলো সস্তায় পাওয়া যায়। যা কিনে সাধারণ মানুষ যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা জামিনে বেরিয়ে আবারও নকল প্রসাধনীর কারবার করছেন। এর অন্যতম কারণ নকল প্রসাধনী বাজারজাত করতে পারলেই বড় অঙ্কের অর্থ পকেটে আসছে। এসব ব্যক্তির নকল পণ্য বাজারজাত করার নেটওয়ার্ক শক্তিশালী। ফলে উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশাপাশি রাজধানীসহ সারা দেশের মার্কেটগুলোতেও সহজে বিক্রি করতে পারছে।

নকল প্রসাধনীর উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। মানহীন প্রসাধনী প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধানে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। যে অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করতে হবে, ভোক্তাদের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে এ ধরনের মানহীন নকল প্রসাধনী ব্যবহারের প্রবণতা কমে আসবে। আশা করি, সরকার এই বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নিন

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৪ এএম
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন
বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নিন

৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘ ঐতিহাসিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এই সম্পর্ক কীভাবে স্বাভাবিক হবে, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। তবে এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। দিন শেষে দুই দেশের সম্পর্কের কালো মেঘ কেটে যাবে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা ও দিল্লির পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। কূটনীতিকদের মতে, উভয় দেশের পারস্পরিক প্রয়োজনেই এই সম্পর্ককে স্বাভাবিক করা দরকার। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে একের পর এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এই সংকটকে ক্রমেই অবিশ্বাস আর অনাস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 

মাঝখানে তৃতীয় পক্ষও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে বহির্বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশেরে সহকারী হাইকমিশনে গত সোমবার হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। 

এই হামলার ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে দুঃখ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরকে ছাড়া চলা কঠিন। এ অবস্থায় দুই দেশের জনগণের মধ্যেও অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। দুই দেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কম হচ্ছে না। এতে জল আরও ঘোলা হচ্ছে। জনগণের পারস্পরিক মেলবন্ধন ও দীর্ঘদিনের যে ঐতিহ্য রয়েছে, তাতেও এর প্রভাব পড়ছে। 

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের এই জটিল সমীকরণের মধ্যেই এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় শুরু হচ্ছে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক। এই বৈঠকে কিছুটা আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। বৈঠকে অনেক সমস্যার কথা উঠে আসবে এবং ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। এতে পারস্পরিক আস্থা আরও বাড়বে, যা আগামী দিনে এই সম্পর্ককে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনবে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে রদবদল হয়েছে। এক কথায় দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই এখন ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ নীতিতে চলছে ভারত। 

কূটনীতিকরা বলছেন, দুই সরকারের বাইরে থেকে নানা ধরনের অপপ্রচার ও পরস্পরবিরোধী উসকানি আসছে, যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলছে। যদিও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক উদ্যোগের যথেষ্ট দক্ষতা ও পেশাদারির অভাব আছে। সম্পর্কোন্নয়নের কূটকৌশলে অনেক ধরনের উপায় আছে। কাজেই কোনটি এখন দরকার এবং কীভাবে উত্তেজনা কমিয়ে এনে পারস্পরিক আস্থা তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আঞ্চলিক সংস্থা সার্ককে কার্যকর করতে চান। এ ক্ষেত্রে ভারতও সার্কের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ফলে সার্ককে কার্যকর করতে হলে ভারতকে সঙ্গে রাখতে হবে। সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতে সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর খবরের কাগজকে বলেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। এই মুহূর্তে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা ভারতকে সম্মান করি, তাদের উচিত বাংলাদেশকে সম্মান জানানো। পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা বুঝতে হবে। দুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করলে সম্পর্কে বাধা আসবেই। তবে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে যে বৈঠক হতে যাচ্ছে, তাতে উত্তেজনা কমতে পারে। এ ধরনের আলোচনা ঘন ঘন চলতে থাকলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। 

ভারত নিকটতম প্রতিবেশী বৃহত্তর একটি দেশ। এ দেশের স্বাধীনতায় ভারতের অবদানের কথা বিবেচনায় রেখেই সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতকেও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কাজেই দুই দেশের সম্পর্ক সমমর্যাদার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাই হোক সম্পর্কের মূল ভিত্তি।

 

দুর্নীতির শ্বেতপত্র পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনুন

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
দুর্নীতির শ্বেতপত্র
পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনুন

যেকোনো দেশের মূল প্রাণপ্রবাহ হচ্ছে তার অর্থনীতি। জীবন-জীবিকার এই প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে গেলে দেশ হয়ে পড়ে রক্তশূন্য। জনজীবন ও রাষ্ট্রে নেমে আসে বিপর্যয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে এমনটিই ঘটেছে। গত রবিবার অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এ তথ্য। ৩৯৭ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে সব মিলিয়ে ২২টি ক্ষেত্রের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি হস্তান্তরের মুহূর্তে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই সময়ে পাচার হয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে ২৮ লাখ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত কুশীলবরা এ কাজটি করেছেন। গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির ভয়াবহ চক্র। পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম হয়েছে অলিগার্কদের। তাদের লুণ্ঠন, লুটপাট ও পাচার এমন মাত্রায় ঘটেছে যে প্রধান উপদেষ্টা সেটা জেনে নিজেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

খবরের কাগজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মূল প্রকল্পের সঙ্গে অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে, কেনার ক্ষেত্রে হেরফের করে এবং কর অব্যাহতি দিয়ে ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত এই ব্যয়ের ৪০ শতাংশ অর্থ লুটপাট করেছেন আমলারা। অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ অসৎ রাজনীতিবিদ ও মধ্যস্থতাকারী ব্যবস্থাপক বা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার ক্রীড়নকরা আত্মসাৎ করেছেন। তারা এই অর্থের প্রায় সবটাই পাচার করেছেন বিদেশে। প্রতিবেদনে হিসাব করে দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার করা অর্থ দিয়ে বিদেশে কেনা হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি এবং বিনিয়োগ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়। পাচারের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বেশ কিছু ছোট দেশে পাচারকারীরা গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সাম্রাজ্য। 

পাচারের এই ভয়াবহ চিত্রটি শুধু লুটপাট নয়, আরও বেশ কিছু বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে আসে। যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের কাছে দেশ বা দেশপ্রেম কখনো গুরুত্ব পাননি। নীতি-নৈতিকতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও পরিবার তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। দেশের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধও তারা করেছেন। নিজের দেশকে সম্পদশূন্য করার এই প্রবণতা একদিকে যেমন বেআইনি, অমানবিক; তেমনি উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। উন্নয়নের যে প্রচার দেখা গেছে, তা ছিল আসলে ‘ওপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ ধরনের মতো বিষয় অর্থাৎ আইওয়াশ। প্রতিবেদনের আরেকটি যে দিক আমাদের নজরে এসেছে তাও মারাত্মক। বিদেশি ঋণ যত এসেছে তার দ্বিগুণ পাচার হয়ে গেছে। একেবারে সাদা চোখে দেখলেও বোঝা যায়, এভাবে অর্থ পাচারের ফলে বাংলাদেশ নানা দিক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু কর অব্যাহতির পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ ও স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ করা যেত। অথচ এই খাতগুলো ধুঁকছে। 

এই প্রেক্ষাপটে এখন আমাদের কী করণীয়, সেটা বিলক্ষণ বোঝা যায়। পাচারের যে চক্র গড়ে উঠেছিল, ভবিষ্যতে সেটা আর দেখতে চাই না। যেকোনো উপায়ে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। আর কিছু না হোক, ফিরিয়ে আনার আন্তরিক উদ্যোগটুকু আমরা দেখতে চাই। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা গেলে রক্তশূন্যতায় কঙ্কাল হয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে প্রাণপ্রবাহের সঞ্চার হবে।

মনোবল ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন পুলিশে এখনো আতঙ্ক কেন

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম
পুলিশে এখনো আতঙ্ক কেন

জুলাই আন্দোলনের পর প্রায় চার মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসন করছে। নতুন সরকার এমন একটা সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে, যখন রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে চলছিল একধরনের অস্থিরতা। অস্থিরতা থেকে দেখা দেয় অব্যবস্থাপনা। নতুন কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে এমনটিই হওয়ার কথা। বিশেষ করে সেই সরকার যদি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত কোনো সরকারের স্থলাভিষিক্ত হয়, হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে যায়, তাহলে দেশ শাসন করাটা সহজ হয় না।

অন্তর্বর্তী সরকারকেও এ রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় দেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। যেহেতু মতাদর্শিকভাবে নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ফলে পাল্টে ফেলতে হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের সব অবকাঠামো। বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে হচ্ছে সবকিছু। কিন্তু এটা সহজ কাজ নয়। খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষিত রাখার কাঠামোটি সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে অব্যবস্থাপনার। জুলাই আন্দোলনের অভিঘাতে পুরো পুলিশি ব্যবস্থাই তছনছ হয়ে গেছে। পুলিশের মধ্যেই আলোচনা আছে, চেইন অব কমান্ড বলতে যা বোঝায় সেটা সেভাবে নেই।

অবশ্য আমাদের অজানা নেই আগে কী কারণে এটা ঘটেছে, এখন কেন ঘটছে। প্রতিবেদন থেকেই দেখা যাচ্ছে, পুলিশকে সব সময় পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিগত সরকারের শেষ দিকে এটা চরমে উঠেছিল। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সব ধরনের দমন-পীড়নমূলক কাজ তারা করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে পুলিশ সম্পর্কে জনরোষ তীব্র হয়েছিল। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে থানা আক্রমণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অস্ত্র লুট হয়েছে, হয়েছে পুলিশ হত্যাও। সাম্প্রতিক সংকটের সূত্রপাত ঘটে তখনই। দুই দিক থেকে, অর্থাৎ পুলিশ ও সাধারণ মানুষ, উভয়েরই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পুলিশ এখন জীবনের ভয়ে ভীত। ফলে কোনো অ্যাকশনে যায় না, গেলেও দেরিতে যায় এবং সংঘাত এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরও পুলিশ-ভীতি চলে গেছে। একদিকে সুযোগসন্ধানী মানুষ মব অপরাধের মতো অপরাধ করতে উৎসাহী হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয় থাকছে, অ্যাকশনে গেলেও কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। জীবনের ভয় ছাড়াও একধরনের ‘অনিশ্চয়তা’ তাদের ওপর ভর করেছে।

খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বর্তমান সরকারের আয়ুষ্কাল নিয়ে পুলিশের সংশয় আছে। এ রকম পরিস্থিতিকে তারা সাময়িক আর অস্বাভাবিক মনে করছে। তাদের অপেক্ষা ‘স্বাভাবিক’ সময়ের। বোঝা যায়, পুলিশ দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচিত কোনো সরকারের অপেক্ষায় আছে। বলাবাহুল্য, এটা পুলিশ বাহিনীর ভাষ্য নয়, ব্যক্তিগতভাবে অনেক পুলিশ সদস্য এ রকমটাই মনে করেন। ফলে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে গিয়ে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এর পাশাপাশি সরকারের কিছু ‘অনিবার্য’ সিদ্ধান্তের কারণে পুলিশের কার্যক্রম এখনো সেভাবে গতি পায়নি। বিশেষ করে ঢাকায় আগে যারা কর্মরত ছিলেন, তাদের ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে পুলিশ এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে সরকার। স্বাভাবিকভাবেই নতুন যারা আসছেন তাদের রাজধানীর অপরাধের গতি-প্রকৃতি বুঝতে সময় লাগছে। কিন্তু অপরাধ এমন যে কখনো থেমে থাকে না। সরকার নতুনভাবে পুলিশ বাহিনীকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সরকার সম্ভাব্য সবকিছুই করছে। গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশের মনের ‘ভয়’ দূর করে ‘মনোবল’ ফিরিয়ে আনার। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি সরকারের আরও কিছু করার আছে। 

সরকার বা পুলিশ প্রথমে যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে পারে সেটা হলো- প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা। জুলাই আন্দোলনের পর নাগরিকরা নিজেরাই চুরি-ডাকাতি ঠেকানোর জন্য এ রকম অসংখ্য সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এখন একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, জুলাই আন্দোলনে যেসব তরুণ অংশগ্রহণ করেছিল, সেসব তরুণকে এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে এনে সাময়িকভাবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তিভিত্তিক পদ্ধতি গড়ে তুলে অপরাধ দমন করার পদক্ষেপ নিতে পারে পুলিশ বাহিনী। আধুনিক বিশ্বের বহু দেশে এ রকম পদ্ধতি চালু আছে। প্রয়োজনে এ জন্য অন্য দেশের অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করে কাজে লাগানো যায়। চতুর্থত, পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো জরুরি। অপরাধ দমনকে আসলে ‘কমিউনিটি’ কার্যক্রমের প্রেরণায় দমন ও প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। শুধু এসব নয়, আরও নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে পুলিশকে সেবামূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলেই আধুনিক জনবান্ধব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বিভাগ গড়ে উঠবে।

আইনের শাসন ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনুন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৮ পিএম
সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

মেয়াদ, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের কারণে সরকার তার কাঙ্ক্ষিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোন খাতে কী সংস্কার করা হবে, তা জানতে ও সম্পন্ন করতে ১৫টি স্বতন্ত্র সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। জানা যায়, ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন কমিটির কাছ থেকে সংস্কার প্রস্তাব পাওয়া যাবে। এরপর এসব প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। সামগ্রিক বিবেচনায় সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি সংস্কার শেষে স্বাভাবিক নির্বাচনি ব্যবস্থায় ফেরাটাও জরুরি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মপরিকল্পনার অন্যতম দিকটি হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। ইতোমধ্যে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের কাজ চূড়ান্ত হলে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়বে বর্তমান সরকারের ওপর। সরকারের মেয়াদ এবং সংস্কারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে, সে বিষয়টি সম্প্রতি সামনে এনেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য চার বা পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকা প্রয়োজন হবে। তবে বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, যৌক্তিক সময়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্বভার ছেড়ে দেওয়া, সম্ভবত এটি ১৮ মাস বা দুই বছর হতে পারে। এ অবস্থায় সংস্কারের বেশির ভাগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ফলে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কারকাজে হাত দিয়েছে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে আইনের শাসন না থাকায় অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র দুটোই আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা ও পরিচর্যা করা হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নেতিবাচকভাবে সামনে আসছে। এ পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকার সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ সরকারের কাছে সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। অন্তর্বর্তী সরকারও বিপুল কাজের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে। সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতেও কাজ করছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে সরকার। জনশক্তি রপ্তানিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উদ্যোগ থেকে আরও জানা যায়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় বর্তমান সরকার কাজ করছে। নেওয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। অভ্যুত্থান-পরবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় চলে আসবে- এমন একটি ধারণা জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচনের সময় নিয়ে তাই এ দলটিও সোচ্চার। রাজনৈতিক দল ছাড়াও সুধী সমাজের প্রতিনিধিরাও এ বিতর্কে যুক্ত হচ্ছেন। বিএনপি বলছে, সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের করার প্রয়োজন নেই। এগুলো নির্বাচিত সরকার করবে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সংস্কার সম্পন্ন না হলে দেশে আবার ফ্যাসিবাদের উত্থান হবে। 

সামগ্রিক সংস্কার ও করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, হাতে নেওয়া সব কাজ সরকার শেষ করতে পারবে কি না, এটা সময়ই বলে দেবে। সময় কতটা পাওয়া যাবে তার ওপর সেসব নির্ভর করছে। তবে দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে এসব সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে সবকিছু স্বাভাবিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হলে কর্তৃত্ববাদের রেখে যাওয়া বিধান বা ব্যবস্থায় হবে না। একদিনে স্বৈরাচারী সরকার সৃষ্টি হয়নি। বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থা বা পদ্ধতিগুলো দূর করতে না পারলে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা দূর হবে না। তাই সংস্কারের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে, যাতে সময় নির্ধারণ করে সরকার দায়িত্ব পালন করতে পারে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনপ্রত্যাশা যেমন বেড়েছে, তেমনি জনপ্রত্যাশার আলোকে সংস্কারের কাজও চলমান রয়েছে। সংস্কার করতে গিয়ে সরকারকে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে সবার আগে দেশে প্রয়োজন আইনের শাসন ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। আশা করছি, অন্তর্বর্তী সরকার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

মব অপরাধ বন্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩২ এএম
মব অপরাধ
বন্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে

মব অপরাধ একটি আইনবহির্ভূত বিষয়। বর্তমানে বহুল আলোচিত শব্দ এটি। কথিত এই মব অপরাধ প্রবণতা সমাজে বাড়ছে। মানুষ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এখন সচেতন মহলের মধ্যে এমনই প্রশ্ন উঠে আসছে। সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সুধী সমাজের প্রতিনিধিরা এর প্রতিরোধে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন। সরকার পতনের পর প্রতিহিংসা বা ঘৃণা-বিদ্বেষের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও এখনো তা থামছে না। বরং সময়-সুযোগ বুঝে অনেকের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। গ্রাম-মহল্লার পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গন, আদালত প্রাঙ্গণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। 

সরকারসহ বিভিন্ন মহল থেকে এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বরং এই অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। যদিও মব জাস্টিসের একাডেমিক কোনো ভিত্তি নেই। এ অবস্থায় অন্যান্য অপরাধের চেয়ে ভয়ংকর এই অপরাধ বন্ধ করা যাবে কি না, তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা মবের মাধ্যমে হত্যা বন্ধে গণসচেতনতা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেছেন। এ ধরনের অপরাধের পেছনে কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, এভাবে অপরাধ করে সহজে পার পাওয়া যায়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়। আবার বিভিন্ন পক্ষের লোক জড়িত থাকায় বিচার-প্রক্রিয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতা ১০০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করে। বিভিন্ন পত্রিকার তথ্য থেকে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়। বিভাগভিত্তিক হিসেবে দেখা যায়, উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে ঢাকায় ৪৪ জন, রাজশাহীতে ১৬, চট্টগ্রামে ১৩, খুলনায় ১১, বরিশালে ৬, সিলেটে ২ এবং রংপুর ও ময়মনসিংহে ৪ জন করে মারা যান। 

গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সমর্থকদের সংঘর্ষ চলাকালে সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটর আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া আদালত অঙ্গনে আসামিদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত বুধবার হাইকোর্টের বিচারকের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একটি দলের শাসনের কারণে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে প্রথমে মব জাস্টিস শুরু হলে অনেক সুযোগসন্ধানী মানুষও নানা ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়ে পরিস্থিতি ঘোলা করছে। এর মধ্যে চুরি, ডাকাতি থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষের জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা, অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জনের মতো ঘটনাও রয়েছে। এ ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হওয়া রাজনৈতিক শক্তির উসকানি থাকা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন তারা। সব মিলিয়ে সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। 

সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকের মতে, মব জাস্টিস বলতে আইনে কিছু নেই। এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, মানুষ মবের মাধ্যমে ক্ষমতা দেখাতে চায়। অনেক সময় নিজে একা ক্ষমতা দেখাতে পারে না। সে কারণে তারা সংঘটিত হয়ে তা প্রদর্শন করে। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনোই কাম্য নয়। দেশে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে তার যথাযথ বিচার হওয়া দরকার। বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি পেয়ে বসলে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সমাজকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ধরনের মব অপরাধ বন্ধ করতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।