
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নানা ইস্যুতে ফাটল দেখা দিচ্ছে। যদিও আন্দোলনের সময় তাদের মধ্যে নজিরবিহীন ঐক্য গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে তাদের মধ্যে নির্বাচন, সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা- এসব বিষয় নিয়ে বিরোধ এখন অনেকটাই স্পষ্ট। প্রতিদিনই পাল্টাপাল্টি মন্তব্য আসছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। এ ছাড়া ছাত্রসংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। নজিরবিহীন ঐক্যের মধ্যে কীভাবে ফাটল ধরল, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ধোঁয়াশা। বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলো বিভিন্ন মতামত দেবে, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে মনে করছেন কেউ কেউ। দীর্ঘদিনের অনিয়ম, বৈষম্য ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও এ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করে।
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোরও দীর্ঘ ১০ বছর ধরে আন্দোলন চলমান ছিল। পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পথও রুদ্ধ হয়েছিল। এসব ক্ষোভের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ায় ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়ে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ সংস্কার নিয়ে কাজ শুরু করে। ইতোমধ্যে স্থানীয় নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যু নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে।
কোনো কোনো দল বলছে আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে ভালো আবার কোনো কোনো দল বলছে আগে জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। জুলাই ঘোষণা নিয়েও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে বিএনপির আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়েও অন্যদের মধ্যে রয়েছে অস্বস্তি। সরকারে থেকে দল গঠন করলে মেনে নেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আনুপাতিক হারে নির্বাচন নিয়েও বড় দুই দলের ভিন্নমত লক্ষ করা যায়।
৫ আগস্টের পর থেকে গণহত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয় ছাত্রলীগ সংগঠনটি। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারেও কথা ওঠে। সীমিত পরিসরে কার্যক্রমের মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। বেশি সক্রিয় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। তাদের নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে অন্য ছাত্রসংগঠনের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। মূলত এই বিরোধের সূচনা হয় গত ৩ ডিসেম্বর। সেদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা মতবিনিময় করেন। পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভায় যোগ দেয়নি ছাত্রদল। তারা আলাদাভাবে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করে।
এতে দূরত্ব বাড়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যেও। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে শিবিরের বিরুদ্ধে গুপ্ত রাজনীতির অভিযোগ আনা হয়। তাদের কমিটির সব সদস্যের নাম প্রকাশ করার কথা বলা হয়। এ নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা সর্বত্র কথা বলেন। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে বক্তব্য দেন দুই সংগঠনের নেতারা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ছাত্রসংগঠনগুলোর এই দ্বন্দ্ব তাদের অবস্থান তৈরিকে কেন্দ্র করে। ছাত্ররাজনীতি ইস্যুতে সমঝোতা না হলে সামনে ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রিমুখী সংঘাত দেখা দিতে পারে। এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবি, ছাত্র উপদেষ্টাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস, আন্দোলন-পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমসহ নানা কারণে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও প্রকট হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর মতে, আমাদের দেশের সবাই রাজনীতি করতে চায়। দেশ ও জনগণের জন্য নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। আমাদের এই ক্ষমতার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। দেশের জনগণ মুক্তি পেয়েছে, দেশে ভালো কিছু হবে- এটিই আশা করছি। আমরা একটা গভীর সংকটের মধ্যে আছি। এ কথাটা দেশের রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও ছাত্র সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অথবা অন্ধকার।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের একটি ক্রান্তিকালীন সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সময়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। যে সংকট এখনো কাটেনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জনপ্রত্যাশা ছিল সংস্কারের। সরকার সে লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জড়িত বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি নিয়ে। বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সেই অনৈক্য একেবারেই স্পষ্ট রূপ পেয়েছে। দেশের কল্যাণে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো পারস্পরিক ঐক্য স্থাপনের জন্য আরও নমনীয় হবে, সেটিই প্রত্যাশা।