
সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে দেশের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও আর্থসামাজিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের শেষের দিকে তা আরও তীব্র হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেড়েছে বৈদেশিক প্রাতিষ্ঠানিক ঋণনির্ভরতা। সরকার সম্ভাব্য নানা উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ রকমই একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
আইএমএফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশকে কয়েক কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। তবে এই ঋণ কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি কিস্তি পেতে সরকারকে সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত প্রতিপালন করতে হবে। সেসব শর্ত পূরণ করা অবশ্য বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, একটি ছাড়া অন্য শর্তগুলো বাংলাদেশ পূরণ করেছে। এ পর্যন্ত তিন কিস্তিতে বাংলাদেশ ২৩১ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে। চতুর্থ কিস্তির টাকা দিতেও আইএমএফ সম্মত হয়েছে। কিন্তু এই ঋণ পাওয়ার জন্য রাজস্ব ক্ষেত্রের যে সংস্কার ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেসবই এখন ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই সংকটের কথা জানা গেছে।
আইএমএফ কিছুদিন আগে এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলেছে, গণ-আন্দোলন, বন্যা ও সংকোচনমূলক পদক্ষেপের কথা। সেই সঙ্গে তারা কীভাবে অর্থনীতি আরও গতিশীল হতে পারে, সেই পরামর্শও দিয়েছে। কর অব্যাহতির ক্ষেত্র কমিয়ে আনা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার ওপর তারা গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে কর-রাজস্ব অনুপাত কম। এ কারণেই একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য রাজস্বব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব ক্ষেত্রের সংস্কার করতে হবে।
পাশাপাশি ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার ওপরও আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকশিল্পকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করার কথা বলেছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সুশাসনের ওপর। চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ের যে শর্ত আইএমএফ দিয়েছে, তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসংক্রান্ত (এনবিআর)। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব প্রশাসন ও রাজস্বনীতি আলাদা, ব্যক্তিশ্রেণি আয়কর থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, করপোরেট কর যৌক্তিক করা, মূল্য সংযোজন করহারে বিচ্যুতি দূর করে অভিন্ন হার নির্ধারণ এবং কর অব্যাহতির তালিকা ছোট করা। এনবিআর সূত্র বলেছে, রাজস্ব প্রশাসন ও রাজস্বনীতি আলাদা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নিয়ে কাজ চলছে। আগামী বাজেটে ভ্যাটে বড় পরিবর্তন আসবে।
ব্যক্তিশ্রেণি করদাতা ও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। করপোরেট করও ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা হচ্ছে। ইতিবাচক এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও এর নেতিবাচক দিকগুলোর কথাও মনে রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফ রাজস্ব বৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব নয়। ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্ত হিসেবে চলতি অর্থবছরের মাঝপথে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছিল সরকার। কিন্তু সেই বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে। অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। ফলে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা থেকে যেখানে ৫১ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে, সেখানে আইএমএফের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যটি অবাস্তব।
এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি, যেসব সংস্কার সম্ভব, সেগুলো দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা উচিত। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কিন্তু তা যেন কোনো অবস্থাতেই সাধারণ মানুষের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি না করে। ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতির চাপে মানুষ দিশেহারা। সরকার পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করতে পারছে না। অর্থনীতির কিছু সূচকে উন্নতি ঘটলেও বেশির ভাগ সূচকে পিছিয়ে আছে। দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে। বহু কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি, রপ্তানি, ব্যাংকব্যবস্থাসহ অর্থনীতিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুসারে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) অর্থনীতি চাঙা হবে, তার আগে নয়। এ রকম অবস্থায় আইএমএফের শর্ত পুরোপুরি পূরণ করা না গেলে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে তাদের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে। কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল ও স্বাভাবিক করা যায়, সে বিষয়ে সরকার অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নিতে পারে। প্রয়োজনে অর্থনীতিসংক্রান্ত জাতীয় কনভেনশনেরও আয়োজন করা যায়। সার্বিকভাবে শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতিও সরকারের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠুক। রাজস্ব আদায়ের নামে সাধারণ মানুষ যেন অস্বস্তিতে না পড়ে, সে রকমটাই প্রত্যাশা আমাদের।