ঢাকা ২ শ্রাবণ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

পবিত্র ঈদুল আজহা: সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের উৎসবে সামিল হোন

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০২:২৭ পিএম
পবিত্র ঈদুল আজহা: সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের উৎসবে সামিল হোন

বর্ষ পরিক্রমায় কদিন পরেই ঈদুল আজহা। ত্যাগ, ভ্রাতৃবন্ধন ও আনন্দযাপনের মহিমায় উজ্জ্বল এই উৎসবটি। ত্যাগ ও আনুগত্যের যে শিক্ষা, সেটাই ঈদুল আজহার শিক্ষা। আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন তার প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন, তখনই নির্দেশ আসে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিনি। ইসমাইলের বদলে কোরবানি দেওয়া হয় একটি দুম্বাকে। এই যে পরীক্ষা, সেটা ছিল প্রিয়বস্তুকে ত্যাগের পরীক্ষা। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা। এই দুই পরীক্ষাতেই প্রতিটি মুসলমানকে উত্তীর্ণ হতে হয়।  কোরবানির প্রতীকী তাৎপর্য এখানেই। ঈদুল আজহার মূল বার্তা হলো আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি নিঃস্বার্থ আনুগত্য এবং মানবতার কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার শিক্ষা। পরবর্তীকালে আত্মত্যাগের ধারাটিই চলে আসছে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে মুসলিম বিশ্বে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমান পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন। 

কোরবানি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক এবং ইহলৌকিক অনুশীলন। কোরবানি মানুষের ভেতরের লোভ, অহংকার, হিংসা, পশুত্ব প্রভৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হওয়ার প্রতীকী উৎসব। আধ্যাত্মিক হচ্ছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য আর ইহলৌকিক হচ্ছে আত্মীয়স্বজন এবং দরিদ্র-দুস্থদের সঙ্গে কোরবানির মাংসকে ভাগ করে নেওয়া। মূল উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধি, আত্মনিবেদন ও পরার্থপরতার চর্চা। ঈদুল আজহা এভাবেই মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্য, সহানুভূতি ও সমবেদনার বার্তা পৌঁছে দেয়। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ দূর হয় এবং মানুষে মানুষে সমতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঈদে ধনী ব্যক্তিরা কোরবানি দিলে এর সুফল ভোগ করেন সমাজের নিম্নবিত্তরাও। সারা বছর যারা মাংসের স্বাদ পান না তারাও ঈদে এর স্বাদ পেতে পারেন। এভাবে ঈদুল আজহা সাম্যের বার্তাও নিয়ে আসে।

ঈদুল আজহার জাগতিক উৎসবের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অবশ্য তখনই পূরণ হবে যখন ভোগ-বিলাসিতাকে পরিহার করে দরিদ্র মানুষের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারব। আমাদের জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। তারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছেন। এই মুহূর্তে দেশের কয়েক জায়গায় বন্যাকবলিত অনেক মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। অনেকের বাঁচার ন্যূনতম সংস্থান নেই। সামর্থ্যবানদের তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াও কর্তব্য। 

পরিবেশের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। কোরবানি দেওয়ার কারণে পশুর বর্জ্যে পরিপার্শ্ব পুতিগন্ধময় আবহে দুঃসহ হয়ে ওঠে। আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব কোরবানির পর সব বর্জ্য ধুয়েমুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। বিশেষ করে ঢাকাসহ বড় বড় জনবহুল শহরের পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আত্মীয় সান্নিধ্যে যারা ঈদের উৎসব পালনের জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করে পথে পা বাড়াবেন, তারা সতর্ক থেকে নিরাপদে যাতায়াত করবেন। অতিরিক্ত কোনো ঝুঁকি নেবেন না। সব দিক থেকেই ঈদুল আজহার দিনগুলো সবার জন্য সুন্দর হয়ে উঠুক, এই আমাদের প্রত্যাশা।

ঈদুল আজহার আনন্দময় উৎসবে খবরের কাগজের অগণিত পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট, বিপণনকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীর প্রতি রইল ঈদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। ঈদ মুবারক।

ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল উৎপাদন বাড়াতে উপযোগী পরিবেশ জরুরি

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম
আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৪:৫৮ পিএম
ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল উৎপাদন বাড়াতে উপযোগী পরিবেশ জরুরি

ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। কার্যকর উদ্যোগের অভাবে আমরা দিন দিন আমাদের এ ঐতিহ্যবাহী সম্পদ হারাতে বসেছি। ইলিশের ভরা মৌসুমেও ক্রেতারা অসহায় ইলিশের দামের কাছে। এমনকি ইলিশের বাড়ি বরিশালেও দেখা মিলছে না ইলিশের। দিনরাত নদীতে জাল ফেলে ইলিশ না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। যা পাওয়া যাচ্ছে, দাম নাগালের বাইরে। ইলিশের আরেক শহর চাঁদপুরেও লাগামহীন দাম। এই দুই জেলার মোকামে আড়াই হাজার টাকার বেশি দরে ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে। সেই ইলিশের কেজি রাজধানীতে ৩ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, দাম ততই বাড়ছে। ইলিশের চড়া দামের জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন আড়তদারদের।

 আবার অনেকে বলছেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইলিশের আহরণ কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়া, নদীদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, নদ-নদীতে ডুবোচর, নদীর মোহনায় নাব্যসংকট ও অবকাঠামো নির্মাণ এবং অবৈধ জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ শিকারের মতো বিষয়গুলো নদ-নদীতে ইলিশ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্য ও দূষণ নদীর পানির গুণমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা ইলিশের আবাস ও চলাচলের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। 

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয় ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টন। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩৪ টন ইলিশ আহরণ হয়েছে। সে হিসাবে গত এক বছরে বরিশাল বিভাগে ইলিশ আহরণ হয়েছে ২৫ হাজার ৫০৯ টন। বরিশাল মৎস্য আড়তদারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, একসময় এখানে বাজারে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মণ ইলিশ আসত। সেখানে বর্তমানে ৮ থেকে ১০ মণ ইলিশ আসছে। সরবরাহ কম থাকায় দাম চড়া। বর্তমানে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা বা কেজি ১ হাজার ৭৫০ টাকা। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম সাইজের ইলিশের দাম ১ লাখ টাকা বা কেজি ২ হাজার ৫০০ টাকা। ১ কেজির ওপরের ইলিশ ১ লাখ ৮ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার বা ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। 

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী ও ইকোফিশ প্রকল্পের সাবেক গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশে আহরিত মোট ইলিশের ৬৬ শতাংশ আসে বরিশাল অঞ্চল থেকে। কিন্তু গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে দেশে ৪২ হাজার টন কম ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। নদীর মোহনায় অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে। স্রোত নেই। দূষণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে নদীগুলো ইলিশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। 

ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণ এবং মানবসৃষ্ট কারণেও ইলিশের প্রজননে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে হলে ইলিশের উপযোগী পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় এবং নদীর পানির গুণগত মান ঠিক রেখে ইলিশের আবাস ও চলাচলের পথকে মসৃণ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

নৃশংসতা নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়! নিয়ন্ত্রণে দরকার কঠোর পদক্ষেপ

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ০১:০১ পিএম
নৃশংসতা নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়!
নিয়ন্ত্রণে দরকার কঠোর পদক্ষেপ

দেশে কতিপয় দুর্বৃত্তের হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। পাথরে থেঁতলে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি পাষণ্ডরা, তারা সোহাগের লাশের ওপর নৃত্যও করেছে। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে, আশপাশের মানুষ এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। একশ্রেণির মানুষের হিংস্রতা, বর্বরতা যেন সব সীমারেখার বাইরে চলে গেছে। তুচ্ছ কারণে কিংবা পুরোনো বিরোধের জেরে ঘটানো হচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

 লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে বীভৎসভাবে হত্যার ঘটনা সারা দেশে ক্ষোভ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা চরমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে! এখন প্রশ্ন উঠেছে- হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে বর্বরতা, হিংস্রতা এত বাড়ল কেন? যেখানে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তার পরও অপরাধীরা কেন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে? এ ঘটনায় সারা দেশে মানুষ বিক্ষুব্ধ। যদিও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল থেকে সারা দেশে চিরুনি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। 

সশস্ত্রবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
পুরান ঢাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ড ছাড়াও চাঁদপুরে খুতবা অপছন্দ হওয়ায় মসজিদের ভেতরে ইমামকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা, খুলনায় যুবদলের সাবেক নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা, চট্টগ্রাম নগরীতে ফাতেমা বেগম নামে এক নারীকে ১১ টুকরা করে হত্যা, গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে চুরির অপবাদে হৃদয় নামে এক শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যাসহ বেশ কিছু বর্বরতার ঘটনায় উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। সোহাগ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির যুবসংগঠন যুবদলের স্থানীয় নেতা-কর্মী জড়িত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। ঘটনাটি বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলটির নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সুধী সমাজের অনেকে বলছেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত লাগাম টেনে ধরতে না পারলে বিএনপির ভাবমূর্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এমনটি ধরে ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে, যা বিএনপির জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। দলটির হাইকমান্ডও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। 

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক কারণে খুন হন ৬৫ জন। মব ভায়োলেন্সের শিকার হন ৮৯ জন এবং বিভিন্ন কারণে ২২০ জন শিশু খুন হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন কারণে আরও কিছু খুনের ঘটনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আসক। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ঢিলেঢালা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কারণে এ-জাতীয় ভয়ানক অপরাধ মাথাচাড়া দিচ্ছে। পরিস্থিতির উত্তরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের কথা বলছেন তারা। তবে শুধু রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। প্রথমত, এর সঙ্গে পারিবারিক দায়বদ্ধতা জড়িয়ে রয়েছে। 

পরিবার থেকে সুশিক্ষা ও শৃঙ্খলাবোধের শুরু। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দায়বদ্ধতা বা ভূমিকার মধ্যে শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সুশিক্ষা দান করা এবং সমাজের বিশিষ্টজনদের সচেতনতা বাড়ানোর বিষয় থাকে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। নৃশংসতা বা বিকৃত আচরণের নেপথ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনকে দায়ী করছেন সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। দেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও বীভৎসতা ঠেকাতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের বিকল্প নেই। সর্বোপরি, অপরাধীদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাও জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকার শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে, যাতে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

চামড়াশিল্পের ভবিষ্যৎ কোন পথে  আন্তর্জাতিক বাজার পেতে মানোন্নয়ন জরুরি

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৪:৫১ পিএম
চামড়াশিল্পের ভবিষ্যৎ কোন পথে 
আন্তর্জাতিক বাজার পেতে মানোন্নয়ন জরুরি

কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের অভাবে মানসম্মত চামড়া রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের এখনো তেমন কোনো আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। অথচ তৈরি পোশাকশিল্পের পরই চামড়া খাতটি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৮২৮ কোটি ডলার। রপ্তানি বেড়েছে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি ডলার।

 সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, কমপ্লায়েন্স বা যথাযথ মান প্রতিপালন করতে পারলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ রপ্তানি খাত আবার ফিরে পাবে হারানো গৌরব। বাড়বে রপ্তানি, চাঙা হবে দেশের অর্থনীতি। দেশের বেশির ভাগ কারখানার পরিবেশ বিশ্বমানের না হওয়ায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে চামড়া ব্যবসায়ীরাও আর্থিক সংকটে ভুগছেন। সরকারের দেওয়া ঋণের পরিমাণও কমছে। এদিক থেকে চীনের চামড়া খাত অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। ফলে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের চামড়া ব্যবসায়ীরা।

 শিল্প খাতের সংশ্লিষ্টরা চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ জানিয়ে বলেছেন, গত ২০ বছরেও সাভার শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে অনেক কারখানায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের চামড়া খাতে স্বল্প সুদে ঋণের সুবিধা দিতে পারলে আর্থিক সংকটে থাকা চামড়া ব্যবসায়ীরা আবারও নতুন উদ্যোমে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা একই কথা বলছেন, এ দেশের চামড়া খাতে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি পরিবেশগত সনদ না পাওয়ায় প্রায় এক দশক ধরে বিশ্ববাজার থেকে প্রায় ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ। একসময় ইতালি, আমেরিকা ও কোরিয়ান ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া নিলেও এখন তারা চীনমুখী হয়েছেন। আর চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে আবাসিক অফিস খুলে ট্যানারি থেকে আড়ত পর্যন্ত নিয়মিত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের একচেটিয়া কারবারে অসহায় অবস্থা এখানকার ব্যবসায়ীদের। এরই মধ্যে গত ২৫ মে কাঁচা চামড়া এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। 

সরকারের এ সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করেছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর ফলে চামড়া উৎপাদনে ট্যানারি-মালিকদের ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া পরিবেশদূষণ বাড়বে এবং ফুটওয়্যার ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়বে। কাঁচা চামড়ার অভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকলে মেশিনারিজ নষ্ট হয়ে যাবে, মূল্য সংযোজনের পরিমাণ কমে যাবে। চামড়া খাতে মোট রপ্তানি আয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম হবে। ফলে ট্যানারি খাতে নিয়োজিত হাজার হাজার শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়বেন। 

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল খবরের কাগজকে বলেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি না দিয়ে বরং কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে চামড়া খাতে স্থিতিশীলতা আসবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে পশু পালনে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। এতে দেশের গুণগত মানের চামড়ার সরবরাহ বাড়বে, যা চামড়া ব্যবসা সম্প্রসারণে সহায়ক হবে। 

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে উৎপাদন করতে না পারলে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব পণ্যকে আন্তর্জাতিক ও গুণগত মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা জরুরি। সেই সঙ্গে সংরক্ষণ নিশ্চিতের ওপর জোর দিতে হবে। যার ফলে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সহজ হবে। প্রত্যাশা করছি, সরকার এ শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

এসএসসির ফলাফল নতুন ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ সময়ের দাবি

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম
এসএসসির ফলাফল
নতুন ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ সময়ের দাবি

দেশের ৯টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এবার যারা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের উষ্ণ অভিনন্দন। 

দেশের ৯টি বোর্ড থেকে এবার পরীক্ষা দেয় ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩১০ জন। পাস করেছে ১০ লাখ ৬ হাজার ৫৫৪ জন। পাসের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় পাসের হার ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। জিপিএ-৫ কমেছে ৩৮ হাজার ৮২৭। সমমানের পরীক্ষার ফলও বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে।

ফলাফলে দেখা যায়, এবার গড় পাসের হার এবং ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫, দুই-ই কমেছে। সেই সঙ্গে সব পরীক্ষার্থী ফেল করেছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। এবার ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। গতবারের চেয়ে এবার এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩টি। কমেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। সব মিলিয়ে অকৃতকার্যদের সংখ্যা ৬ লাখের সামান্য বেশি। সেই হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর ৩২ শতাংশ এবার অকৃতকার্য হয়েছে, প্রতি ১০০ জনে ফেলের সংখ্যা ৩২ জন।
 
কেন এবার এ রকম ফলাফল হলো, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মূলত চারটি কারণে এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। সেই কারণগুলো হলো খাতার যথাযথ মূল্যায়ন, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়ি, ইংরেজি-গণিতে পাস করতে না পারা, করোনা ও জুলাই আন্দোলনের প্রভাব। যথাযথভাবে খাতার মূল্যায়নের বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ঢিলেঢালা মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের সঠিক পদ্ধতি নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই এটা করা হয় না। এতে সাময়িকভাবে উল্লসিত হওয়া গেলেও শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন ঘটে না। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রচলিত এই ধারা থেকে এই প্রথম শিক্ষা বোর্ডগুলো বেরিয়ে এল। ভবিষ্যতেও এই ধারা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।

এবারের ফলাফলের দুটি দিক লক্ষণীয়। একটি দিক যথাযথ ফলাফলের, অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যেমন পরীক্ষা দিয়েছে, ঠিক তেমনই ফলাফল করেছে। আরেকটা দিক হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তারা শিক্ষাধারার পরবর্তী ধাপে চলে যাবে। কিন্তু আমাদের এখন নজর দিতে হবে ফেল করা শিক্ষার্থীদের দিকে। আর ভাবতে হবে ভবিষ্যতের কথা। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের যদি আমরা শিক্ষাধারায় ধরে রাখতে না পারি, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফেল করা শিক্ষার্থীদের এই ধারায় ধরে রাখাটাই হবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। যে ফল হওয়ার কথা তাই হয়েছে বলে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। সরকারসহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে। 

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়াটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থারই ত্রুটি। জাতিগতভাবে আমরা তাদের উত্তীর্ণ হওয়ার পর্যায়ে উন্নীত করতে পারিনি। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যার লোকসংখ্যা এই অকৃতকার্য ৬ লাখ শিক্ষার্থীর চেয়েও কম। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ফেল করাটা আসলে আমাদের অর্থনীতি ও মানবসম্পদের বড় অপচয়। এতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটে বিপন্ন হয়ে পড়ার শঙ্কাও থাকে। অতীতে অকৃতকার্য হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এসব আমরা যেন ভুলে না যাই। তবে এই ফলাফল ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। সেই শিক্ষাটা হচ্ছে ঠিকমতো পড়াশোনা না করে কোনো শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় পাস করার সুযোগ নেই। 

এর অবশ্য আরেকটি আশঙ্কার দিক রয়েছে। সেটা হলো, পড়াশোনার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘চাপ’ হয়ে দেখা দিতে পারে। কোচিং, টিউটর, গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসাও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। আসলে আমাদের পাবলিক পরীক্ষাব্যবস্থারই বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। পুরো পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত না করে, অর্থাৎ বোর্ডের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও বিদ্যালয়গুলোকে সম্পৃক্ত করা দরকার। এটা নিঃসন্দেহে শিক্ষানীতির বিষয়। এতে অনেকে দুর্নীতির সুযোগ ঘটতে পারে বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখন এমন এক সৎ শিক্ষকমণ্ডলী গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে, যারা সততার সঙ্গে শিক্ষাদান করবেন। তবে এক-দুই বছরে সেটা ঘটবে না। নীতি-নৈতিকতানির্ভর সমাজ হলেই আমরা নীতিবান শিক্ষক পাব। দেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল হলেই এটা সম্ভব। 
দুর্নীতি নির্মূলে বৃহৎ পরিসরে সরকারকে কাজ করতে হবে।

 শিক্ষকদের বেতনসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে সেসব শিক্ষকদের, যারা শিক্ষকতাকে মহান পেশা মনে করে নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড রক্ষা করে শিক্ষকতা করবেন। তবে আপাতত যা করণীয় তা হচ্ছে, কীভাবে কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া। এ জন্য নতুন করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে সেই কাজটি সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সম্পন্ন করাই হবে যথাযথ পদ্ধতি। এটা করতে গিয়ে কোনো বিতর্কে জড়ানো যাবে না। মনে রাখা জরুরি, এবারের ফলাফলের প্রেক্ষাপটে আমাদের মাধ্যমিক ও সমমানের শিক্ষা নতুন একটা পর্বে প্রবেশ করেছে। এই শিক্ষাস্তর নিয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোগও তাই সময়ের দাবি।  

 

রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে এখনো অনৈক্য জাতীয় নির্বাচন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:১১ পিএম
রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে এখনো অনৈক্য
জাতীয় নির্বাচন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়

শুরু থেকেই দেশের সচেতন মানুষ লক্ষ রাখছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ডের দিকে। বিশেষ করে সংবিধান ও নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কতদিনে কী ধরনের সংস্কার হয়, তাই নিয়ে সাধারণ মানুষের তীব্র কৌতূহল রয়েছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সক্রিয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী মহলও এই সংস্কার সম্পর্কে আগ্রহী। কেননা, বর্তমান পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি অনুসারে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই সংস্কারের ওপর। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে এর সাফল্যের ওপর। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত শেষবিন্দুতে পৌঁছাবার।
 তাদের সঙ্গে শুরু থেকেই আলোচনায় অংশ নিচ্ছে ছোট-বড় আমন্ত্রিত ২৮টি রাজনৈতিক দল ও দুটি জোট। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফার বৈঠক শেষে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করছে। 

গত অক্টোবরে ছয়টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব কমিশনের মধ্যে জনপ্রশাসন ছাড়া বাকি পাঁচ কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা। 

প্রথম দফায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠক করে। তবে সংস্কার-প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অনেক বিষয়ে দলগুলো একমত হতে পারেনি। এরপর সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় দফার বৈঠক। গত ৭ জুলাই পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১০টি বৈঠক করেছে। 

প্রথম দফার বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামত বিবেচনায় নিয়ে দ্বিতীয় দফায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ২০টি মৌলিক বিষয় আলোচনার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত ১৪টি বিষয়ের মধ্যে ঐকমত্য হলেও এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে আটটি বিষয়। এ ছাড়া অনালোচিত আরও ছয়টি বিষয়, যেমন প্রধানমন্ত্রীর কার্যকালের মেয়াদ ১০ বছর রাখা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোসহ বেশ কিছু বিষয়ে দলগুলো ঐক্যের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। 

আশা করা হচ্ছে, চূড়ান্ত আলোচনা শেষে বেশির ভাগ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারবে। চলতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার ব্যাপারে কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ আশাবাদী। দলগুলো অঙ্গীকারবদ্ধ যে তারা জাতীয় সনদে সই করবে। আমরা এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে তাকে স্বাগত জানাই। কমিশনের প্রচেষ্টাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। কিন্তু পথের শেষ আলোকবিন্দুটি এখনো পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়নি।  

রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিতীয় দফার বৈঠকে এ পর্যন্ত মাত্র ছয়টি বিষয়ে একমত হতে পেরেছে। বিষয়গুলো হচ্ছে সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণ। তবে ছয়টি নতুন বিষয়সহ এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে আরও আটটি বিষয়।

ঐকমত্যে না পৌঁছানো সেসব বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের মূলনীতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি (যার আগে প্রস্তাবিত নাম ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল- এনসিসি), দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি) এবং সংসদে নারী আসন নির্ধারণ (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি)। 

এ ছাড়া এখনো অন্তত ছয়টি মৌলিক বিষয়ে আলোচনা করতে পারেনি ঐকমত্য কমিশন। এই বিষয়গুলো হচ্ছে সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, সংসদ সদস্যদের একাধিক পদে থাকার বিধান, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব।

আমরা মনে করি, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আর এক সপ্তাহ বা দেড় সপ্তাহের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো জরুরি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাইয়ের শেষ নাগাদ যেহেতু জাতীয় সনদ তৈরি করতে চায়, ফলে হাতে তেমন সময় নেই। সব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভালো হতো, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে তাদের মধ্যে সব বিষয়ে ঐকমত্য যে প্রতিষ্ঠিত হবে না, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছে। কমিশনও এটা প্রত্যাশা করে না। 

এটাই হচ্ছে বাস্তবোচিত অবস্থান। আমরা মনে করি, যেসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে, সেসব বিষয় নিয়েই জাতীয় সনদ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আর অমীমাংসিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নির্বাচনের পরেও নেওয়া যাবে। সংস্কার তো একটা চলমান প্রক্রিয়া। 

জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়াই এখন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। আমরাও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলতে চাই, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে জাতীয় সনদ তৈরি করা যেতে পারে। দেশ বহু আকাঙ্ক্ষিত এই বড় ধাপটি পেরিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাক।