প্রবন্ধ রচনা
শ্রমের মর্যাদা
ভূমিকা: ‘... a hard working street
cleaner is a better man
than a lazy scholar.’
অণু থেকে অট্টালিকা পর্যন্ত বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে শ্রম। মানুষ তার মেধা, শক্তি ও শ্রম দিয়ে তার অভাব পূরণ করে। শ্রমের মাধ্যমে মানুষ তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়। এজন্য বলা হয়, ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।’
তাই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন-
‘মানুষের জন্য শ্রম ছাড়া কিছুই নেই।’
শ্রম কী: কবির ভাষায়-
‘নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ চন্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস।
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু-বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি কৃষি তন্তুজীবী স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার।’
শারীরিক ও মানসিক উভয়ের এমন একটি শক্তি যা দিয়ে নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের ফলে মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে। পরিশ্রমের মাধ্যমে ব্যক্তি বা জাতি সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে পারে আবার পরিশ্রম বিমুখ হলে ওই ব্যক্তি বা জাতির পতন অনিবার্য। শ্রম বলতে কায়িক ও মানসিক উভয় প্রকার পরিশ্রমকে বোঝায়।
শ্রমের শ্রেণিবিভাগ: মানব সমাজে দুই ধরনের শ্রমেরই মূল্য আছে। সব ধরনের শ্রমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
(১) দৈহিক শ্রম ও (২) মানসিক শ্রম।
দৈহিক শ্রম: যারা দেহ খাটিয়ে পরিশ্রম করে, তাদের শ্রমকে দৈহিক শ্রম বলে। জগতের সব জীবকেই বেঁচে থাকার জন্য কম-বেশি শারীরিক মানসিক শ্রম দিতে হয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের শারীরিক শ্রমের জন্য হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েছেন। শারীরিক শ্রম আত্মসম্মানের পরিপন্থি নয় বরং সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রধান উপায়। তাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
“শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজ্রানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফুলে”
মানসিক শ্রম: মানসিক শ্রম ছাড়া মানসিক উন্নতি সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, শিল্পীর পরিশ্রম মূলত মানসিক। তবে তাদের এই মানসিক শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে গিয়ে তারা কায়িক শ্রমও করে থাকেন। শ্রমবিমুখ ব্যক্তির মনে কখনো সুচিন্তা উদয় হয় না। কথায় আছে- “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।”
শ্রমের প্রয়োজনীয়তা: Virgil বলেন, ‘The dignity of labour makes a man self confident and high ambitious. So, the evaluation of labour is essential.’ ঠিকই মানবজীবনে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মানুষ নিজেই তার নিজের ভাগ্যের নির্মাতা। আর এই ভাগ্যকে নির্মাণ করতে হয় নিরলস শ্রম দিয়ে। মানবজীবন অত্যন্ত কর্মমুখর। বহু প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। শ্রম ছাড়া জীবনের উন্নতি কল্পনা মাত্র। ছোট হোক বা বড় সবারই কাজের প্রয়োজন আছে এবং যার যার দায়িত্ব যথাযথ পালনের মধ্যে জীবনের সুখকর অস্তিত্ব নির্ভরশীল। জীবনের উন্নতির চাবিকাঠি পরিশ্রমের মধ্যে বিদ্যমান। তাই সবাই সব রকম কাজের প্রতি সমান আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। জীবনের সঙ্গে শ্রমের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মানব জীবনের শ্রমের এই বিশেষ গুরুত্ব দেখাতে গিয়ে কবি বলেছেন-
‘চাষী ক্ষেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার,
তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’
উন্নত দেশে শ্রমের মর্যাদা: ‘Work is the basis of self respect’ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো একমাত্র শ্রমের মর্যাদা ও মূল্যায়নের গুণেই উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পেরেছে। খন্দকার মুহাম্মদ ইলিয়াসের ভাষায়- ‘শ্রমিকের শ্রম মানব সভ্যতার জনক।’
আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, চীন, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশের মানুষের শ্রমের কারণে, ওই সব দেশ আজ উন্নতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। শ্রমকে তারা খুবই মর্যাদা দেয়। তারা কোনো কাজকেই ছোট, ঘৃণ্য ও অপমানজনক মনে করে না। তাদের স্লোগান হচ্ছে-
‘পরিশ্রমের দ্বারা উন্নতি করো অথবা নিপাত যাও।’
সুতরাং বলা যায় যে, উন্নয়নের জন্য শ্রমকে তারা নিজেদের চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ধ্যান-ধারণার সঙ্গে একাত্ম করে নিয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমের মর্যাদা: ‘Luck Is What Happens When Preparation Meets Opportunity.’ বাংলাদেশে শ্রম প্রধানত বর্ণগত। যারা উঁচু বর্ণের তারা কোনো কাজ করে না। নিচু বর্ণের লোকেরা দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কায়িক শ্রমের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের এক ধরনের ঘৃণা রয়েছে। ফলে এ দেশের শিক্ষিত সমাজের একটা বিরাট অংশ কায়িক শ্রম থেকে দূরে সরে থাকে। শিক্ষিত ও অভিজাত শ্রেণির লোকেরা মনে করেন দৈহিক শ্রম তাদের জন্য নয়। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- ‘Idle brain is the devils workshop’.
(বাকি অংশ আগামীকাল প্রকাশ করা হবে)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, উত্তরা, ঢাকা
কবীর