
পঞ্চম অধ্যায় : প্রাচীন বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর-৫
উদ্দীপকটি পড়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর লেখ।
মৃণাল ব্যানার্জি ও রূপক বণিক দুই বন্ধু এবং একই শহরে বসবাস করে। মৃণালের বাবা ব্যবসা করেন এবং তার দোকানে টাঙ্গাইলের তাঁত, রাজশাহী সিল্ক ও জামদানি শাড়ি বিক্রি করা হয়। বর্তমানে তিনি সুতি কাপড় ও সিল্ক শাড়ি বিদেশে রপ্তানি করছেন। রূপকের বাবা চাল, চিনি, ডাল, লবণ, মসলা ইত্যাদির ব্যবসা করেন। তিনি চিনি ও মসলা আমদানি করেন। একদিন রূপক মৃণালের বোনের সঙ্গে তার বড় ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারা ফিরিয়ে দেয় শ্রেণি বৈষম্যের কারণ দেখিয়ে।
ক. কখন থেকে বাংলার মুদ্রার প্রচলন হয়? ১
খ. প্রাচীন বাংলার মানুষের অবস্থা কেমন ছিল? ২
গ. রূপকের বড় ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাবে প্রাচীন বাংলার শ্রেণি বৈষম্যের কোন দিকটি ওঠে এসেছে।৩
ঘ. তুমি কি মনে করো রূপকের বড় ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে সে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, তা তৎকালীন বাংলার সমাজের অগ্রগতির পথে অন্তরায় যুক্তি
দাও। ৪
উত্তর: ক. বাংলায় মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়কালে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১-১৮৫)। মৌর্য যুগে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়, যা তৎকালীন বাংলার অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
খ. বিস্তারিত বিশ্লেষণ: প্রাচীন বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা ছিল কৃষিনির্ভর এবং সমাজব্যবস্থা সম্প্রদায়ভিত্তিক।
১. অর্থনৈতিক অবস্থা: বাংলার অর্থনীতি মূলত কৃষি ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তখন ধান, পাট, মসলা ইত্যাদি ফসলের উৎপাদন ছিল প্রধান।
• এ ছাড়া তাঁতশিল্প এবং রেশমের মতো কুটিরশিল্পের প্রচলন ছিল।
• নদীপ্রধান বাংলায় নৌপথে বাণিজ্য করা সহজ ছিল, যা অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল।
২. সামাজিক অবস্থা: সমাজ ছিল বর্ণভিত্তিক। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, এই বর্ণব্যবস্থায় তখন শ্রেণিবৈষম্য ছিল প্রকট।
• জাতপাতের কারণে সামাজিক সম্প্রীতিতে বাধা সৃষ্টি হতো।
৩. সংস্কৃতি: মানুষ উৎসবমুখর জীবনযাপন করত। পূজাপার্বণ, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাই অংশগ্রহণ করত।
• শিল্পকলা: যেমন: সংগীত, নৃত্য এবং চিত্রকলায় মানুষের দক্ষতা ছিল।
সামগ্রিকভাবে, প্রাচীন বাংলার মানুষ পরিশ্রমী এবং আত্মনির্ভরশীল ছিল, তবে বর্ণভেদ প্রথা এবং শ্রেণিবৈষম্য তাদের সামাজিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করত।
আরো পড়ুন :প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস অধ্যায়ের ১টি সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর, ৪র্থ পর্ব
গ. মৃণালের বাবা-মায়ের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য বিদ্যমান থাকার কারণে তারা রূপকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। যা ছিল বাংলার বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এবং বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
ব্যাখ্যা: ১. বর্ণভেদ প্রথার প্রতিফলন: ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং শূদ্রের মধ্যে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য প্রাচীন বাংলার এক বিশেষ দিক। বৈশ্য পরিবার থেকে আসা রূপকের ভাইয়ের প্রস্তাব মৃণালের পরিবার গ্রহণ করেনি, যা বর্ণভেদ প্রথার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে।
২. অর্থনৈতিক শ্রেণি: যদিও মৃণালের পরিবার ব্যবসায়ী এবং রূপকের পরিবারও ব্যবসায়ী, তবুও জাতপাত এবং সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে দুই পরিবারের মধ্যে বৈষম্য বজায় ছিল।
৩. সামাজিক সংস্কার: এটি বাংলার সেই সময়ের সমাজব্যবস্থার একটি চিত্র, যেখানে সামাজিক সম্পর্ক, জাতি বা পেশার ওপর নির্ভর করত।
উদ্দীপকের শ্রেণিবৈষম্য ও বর্ণভেদ প্রথা বাংলার বৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে।
ঘ. হ্যাঁ, এটি ছিল তৎকালীন বাংলার সমাজের অগ্রগতির পথে অন্তরায়।
যুক্তি: ১. সমাজে বিভেদ: জাতপাতের কারণে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়। এটি পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সামাজিক বন্ধনকে দুর্বল করে।
২. সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত: বর্ণভিত্তিক সমাজে সবার সমান অধিকার না থাকায় সমাজের একটি বড় অংশ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়। এটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থবিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৩. শিক্ষা ও সংস্কারের অভাব: তৎকালীন সমাজে শিক্ষার অভাব এবং রক্ষণশীল মানসিকতা জাতপাতের কুসংস্কারকে আরও গভীর করে তোলে।
৪. অর্থনৈতিক বৈষম্য: যদিও উভয় পরিবারই ব্যবসায়ী, তবুও শ্রেণি বৈষম্যের কারণে মৃণালের পরিবার রূপকের পরিবারকে সমান মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না। এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
সুতরাং বাংলার সমাজকে অগ্রগামী করতে হলে এই জাতপাত এবং শ্রেণি বৈষম্য দূর করতে হবে। সবার মধ্যে সমান অধিকার এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই একটি শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
সুতরাং রূপকের বড় ভাইয়ের বিয়েতে জাত ও বর্ণভেদ প্রথার কারণে বাধা সৃষ্টি হওয়া তৎকালীন বাংলার সমাজের একটি বড় সমস্যা, যা সমাজের অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে।
লেখক : সহকারী শিক্ষক
সাভার অধরচন্দ্র সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা
কবীর