
প্রবন্ধ রচনা
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প
(১২ জানুয়ারি প্রকাশের পর)
৬. ঐতিহাসিক স্থাপনা: বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণে স্থাপিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদদের প্রতি নিবেদিত ও ঢাকার সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুরে নির্মিত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং এই উদ্যানে স্থাপিত স্বাধীনতা জাদুঘর ইতিহাসপ্রেমী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের অবস্থা: পর্যটন বিশ্বব্যাপী একটি সম্ভাবনাময় খাত। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের সম্মিলিত বার্ষিক ভ্রমণ ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এমন অনেক দেশ রয়েছে, যাদের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প দিনে দিনে বিকাশ লাভ করছে। একদিকে বিদেশি পর্যটকদের আগমন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়িয়ে তুলছে, অন্যদিকে দেশীয় পর্যটকদের ভ্রমণ সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ লাখ দেশীয় পর্যটক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই বিপুলসংখ্যক পর্যটক বিভিন্ন স্থানে চলাচল করায় পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতি গতি লাভ করে। পরিবহন, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, পোশাক, অলংকার প্রভৃতি ব্যবসা পর্যটনশিল্পের বিকাশের সঙ্গে জড়িত। পর্যটনের বিকাশে অসংখ্য মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, পর্যটনশিল্প থেকে দেশের ১০ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি অর্জন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব: বর্তমান সময়ের দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প হলো পর্যটনশিল্প। এ শিল্প তার বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পে উপার্জন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে ১৯৯৯ সালে পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এটি বেড়ে ২০০৮ সালে ৬১২ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। বাংলাদেশের GDP-এর প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। পর্যটনশিল্পে প্রায় ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১২ সালে মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১২ সালে পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত ছিল দেশের ১২ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যা মোট চাকরির ১ দশমিক ৮ শতাংশ। (সূত্র: WOTTC Report 2012)
বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পের সমস্যাগুলো: বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় নিয়ামক পর্যটনশিল্প নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ হচ্ছে না। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সমস্যাগুলো হলো-
১) রাজনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাই পর্যটনশিল্পের জন্য বড় হুমকি। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত থাকার কারণে এ দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
২) যোগাযোগ এবং অবকাঠামোগত সমস্যা: এ দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় যাওয়ার জন্য যেমন আরামদায়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব ঠিক তেমনি সেখানকার আবাসন ব্যবস্থাও ভালো নয়। তাই পর্যটনকেন্দ্রগুলো আকর্ষণীয় হলেও পর্যটকরা যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
৩) আকর্ষণীয় প্রচারণার অভাব: বাংলাদেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্য নিয়ে আকর্ষণীয় প্রচারণা চালানো হয় না। ফলে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ এসব আকর্ষণীয় স্থান সম্পর্কে জানতে পারে না।
৪) দক্ষ গাইডের অভাব: বিদেশি পর্যটকদের পথ দেখানো থেকে শুরু করে পর্যটনকেন্দ্র সম্পর্কিত ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যে দক্ষ গাইডের প্রয়োজন বাংলাদেশে তার বড়ই অভাব। দোভাষী গাইডের সংখ্যা যত বৃদ্ধি করা যাবে বাংলাদেশে তত বেশি বিদেশি পর্যটক আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
৫) সরকারি উদ্যোগের অভাব: বাংলাদেশের সরকার পর্যটনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে সব সময়ই অবহেলা করে এসেছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকার কথা থাকলেও স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও তা সম্ভব হয়নি।
৬) বেসরকারি উদ্যোগের অভাব: বাংলাদেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে খুব কমই আছেন যারা পর্যটনশিল্পের দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকেন। প্রায় সব দেশেই পর্যটনশিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে সে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং নিশ্চিত নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে চান না।
৭) পর্যাপ্ত এবং উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব: পর্যটকদের বারবার আকৃষ্ট করার জন্য পর্যটনকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের উন্নত ধরনের এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা খুবই সীমিত।
৮) নিরাপত্তার অভাব: বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প নিরাপত্তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, বিদেশিরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত বা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় পূর্ণ নিরাপত্তার অভাবের কারণে বিদেশিরা অনেক সময় বাংলাদেশে আসেন না।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে করণীয়: বাংলাদেশের উন্নয়নের গতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পর্যটনশিল্পের সমৃদ্ধি প্রয়োজন। এ জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-
১) পর্যটন নীতিমালার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে।
২) পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় সহজে পৌঁছানো যায় এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩) বিদেশি পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে পর্যটন কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পর্যটন বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে।
৫) প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতাসম্পন্ন পর্যটক গাইড গড়ে তুলতে হবে।
৬) পরিবহন খাতের ঝুঁকি কমাতে হবে। যাতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই বিমান, লঞ্চ, বাস বা অন্যান্য যানবাহনে করে পর্যটনকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে।
৭) সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
৮) বাংলাদেশের প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যগুলোকে প্রচারণার মাধ্যমে উপস্থাপন করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে।
৯) সর্বোপরি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
১০) যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়াসহ সংশ্লিষ্ট ব্যয় যাতে সীমার মধ্যে থাকে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
উপসংহার: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্থাপত্যকলা, স্থানীয় অধিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ও সংস্কৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। তবে পর্যটনকে একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ও স্থায়ী রূপ দিতে দরকার রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি পর্যটনকেন্দ্রের অধিবাসীদেরও পর্যটকদের সহযোগিতায় সম্পৃক্ত করা উচিত। পর্যটকদের যথাযথ নিরাপত্তা ও সহযোগিতা দিলে ভ্রমণের প্রতি তাদের উৎসাহ আরও বাড়বে। ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মানবিক সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিচয় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে। এ জন্য মুগ্ধ হয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা
কবীর