প্রবন্ধ রচনা
মানবকল্যাণে বিজ্ঞান/দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান/ বিজ্ঞানের অবদান
ভূমিকা: মানুষের অনুসন্ধিৎসু চোখের কাছে প্রকৃতির রহস্য আজ উন্মোচিত। মানুষ তার যুগ-যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনা দিয়ে প্রকৃতির বুকে সভ্যতার এই বিশাল ইমারত গড়ে তুলেছে। ইংরেজিতে আছে, ‘Man is the best of creature’. কাজেই মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আর চিন্তাশক্তির ক্ষমতা মানুষকে এই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। জীবন আর বিজ্ঞান আজ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানব জীবনের কল্যাণে বিজ্ঞানের অবদানের উদাহরণ প্রতিনিয়ত প্রকাশ হচ্ছে। মানবসভ্যতার মূলে বিজ্ঞানের অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও আবিষ্কার থেকে লক্ষ করা যায়। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার শেষ নেই। বিজ্ঞান আজ মানবসভ্যতার এক নিত্যসঙ্গী। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ বিজ্ঞানের কল্যাণে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন,
“Science is reality
Science is bonafide
Science is your constant friend
Science is always creative.”
বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য: বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ও ধারণা নিছক কল্পনাবিলাস নয়। একজন বিজ্ঞানী কোনো তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অবশেষে সত্যে উপনীত হন। বিজ্ঞানের সাধনা যে নিছক কল্পনা নয় সে সম্পর্কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘এক কেজি ভর বিশিষ্ট কোনো পদার্থকে এবং একটি এক পয়সার মুদ্রাকে একই উচ্চতা থেকে একসঙ্গে ছেড়ে দিলে এক কেজি ভর বিশিষ্ট পদার্থটি আগে মাটি স্পর্শ করবে কিন্তু একজন বিজ্ঞানীর কর্তব্য তা যাচাই করে দেখা।’ সত্যি কথা হলো, এভাবে সত্যতা নির্ণয়ের নির্দেশনা দেয় বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান কথাটির অর্থ: সাধারণভাবে বিজ্ঞান কথাটির অর্থ বলতে বিশেষ জ্ঞানকে বোঝায়। অনুসন্ধিৎসু মানুষের বস্তুজগৎ সম্পর্কে ধারণা এবং বিচিত্র কৌশলে তার ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা থেকে বিশ্বের অনেক জিনিস আবিষ্কার হয়েছে। এসব আবিষ্কারের পেছনে আছে কার্যকর সূত্র আর এ ধরনের যুক্তিযুক্ত আবিষ্কারকেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলে অভিহিত করা যায়। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার ঘটেছে মানুষের প্রয়োজনে। মানুষের অভাববোধ থেকে। মানুষের যাত্রাপথের সঙ্গে তাই বিজ্ঞান জড়িত। মানব জীবনের বিচিত্র গতির নিয়ন্ত্রক হলো বিজ্ঞান। মানবসভ্যতার বিকাশের সহায়ক হিসেবে কাজ করে বিজ্ঞান। মানবসভ্যতার অগ্রগতির পেছনে শক্তি সঞ্চার করে বিজ্ঞান মানুষের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে মানুষের নিরন্তর প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিজ্ঞান আরও সৃষ্টিমুখর হয়ে উঠেছে।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ: মানুষ বিশ্বের বুকে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপকে বিজ্ঞানের অবদানের বদৌলতে সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করেছে তা সভ্যতার বিকাশের প্রেক্ষিতে বিপুল সফলতা লাভ করেছে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে মানুষ আজ যে যুগে উপনীত হয়েছে তাকে বিজ্ঞানের যুগ বলে অভিহিত করা যায়। মানুষ বেড়েছে, তার প্রয়োজনও ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে মানুষ বিজ্ঞানের অজস্র আবিষ্কারকে নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগিয়ে জীবনকে সুখময় করে তুলেছে। বিজ্ঞানকে নানাভাবে প্রয়োগ করে মানুষ তার সভ্যতা সমৃদ্ধ করেছে। আজকের সভ্য জগতে বিজ্ঞানের ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। এখন বিজ্ঞান ছাড়া একটি মুহূর্তও চলে না। কারণ দৈনন্দিন জীবনে যা প্রয়োজন তা এখন বিজ্ঞানের অবদান থেকে লাভ করা যায়। সবকিছুতেই বিজ্ঞানের আধিপত্য রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এ যুগকে বিজ্ঞানের যুগ বলা যায়।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা, ২য় পর্ব
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা: যুগ-যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনা দিয়ে মানুষ বিজ্ঞানের ওপর প্রভুত্ব আরোপ করেছে। মানুষের অক্লান্ত কর্মসাধনার ক্রমপরিণতি হচ্ছে বিংশ শতাব্দীকে অতিক্রম করে একবিংশ শতাব্দীতে যাত্রা। মানবসভ্যতার এই উন্নয়ন রচিত হয়েছে অনেক গবেষকের ত্যাগ-তিতিক্ষা, ব্যর্থতার হা-হুতাশ ভেদ করে। বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে মানুষ আজ খনির অন্ধকারে আলো জ্বেলেছে; ঘুম ভাঙিয়েছে পাতালপুরীর ঘুমন্ত রাজকন্যার, দৈত্যপুরের বন্দিশালা থেকে তাকে মুক্ত করে এনে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে সাজিয়েছে। উদ্ভাবন করেছে বিজ্ঞানে নব নব কৌশল ও প্রকরণ। পৃথিবীর শৈশবের জড়তা কাটিয়ে নিয়ে এসেছে যৌবনের অফুরন্ত কর্মশক্তি ও গতির উল্লাস। অন্যদিকে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ উচ্ছৃঙ্খল নদীস্রোতকে বশীভূত করে ঊষর মরু প্রান্তরকে জলসিক্ত, চাষাবাদের উপযোগী করেছে। ভূগর্ভের সঞ্চিত সম্পদ পৃথিবীর মানুষের সম্ভাবনাকে করেছে উজ্জ্বল। বিজ্ঞান আজ আবিষ্কার দিয়ে ক্ষয়িঞ্চু বসুধাকে শস্যবতী করে তুলেছে।
বিজ্ঞানের দান: উনিশ এবং বিশ শতকে মানুষ নতুন নতুন ও অভিনব আবিষ্কারের মাধ্যমে জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার মানবজাতির সম্মুখে উন্নত সভ্যতার সূচনা করেছে। রোটারি, প্রেস, ফটো, অফসেট মেশিনের আবিষ্কারের ফলে মুদ্রণ জগতে এক অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়োজাহাজ আবিষ্কার, ভেখ মলারের মোটরসাইকেল, ইগন মিগস্কির হেলিকপ্টার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানীদের সাফল্যমণ্ডিত আবিষ্কার যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে। উড়ন্ত ট্যাক্সি, আণবিক শক্তি, কম্পিউটার, রোবট ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞান মানুষের জীবনে অগ্রগতির ধারাকেই তুলে ধরেছে।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান: বিজ্ঞানী মাদাম কুড়ি বলেছেন, আমার চোখে বিজ্ঞান অনিন্দ্যসুন্দর এবং আমরা সবাই এর সদস্য। প্রতিদিন মানুষ সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে বিছানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত অকাতরভাবে বিজ্ঞানের দান গ্রহণ করছে। আমাদের অনেকেরই ঘুম ভাঙে ঘড়ির অ্যালার্ম শুনে। ঘুম থেকে উঠে দাঁতের মাজন, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ তারপর হাতমুখ ধোয়ার জন্য শহরে বেসিন শাওয়ার আর গ্রামে টিউবওয়েল, দেশ-বিদেশের খবর দেখার জন্য নাশতার টেবিলে সংবাদপত্র থাকে। এ ছাড়া রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি থেকে খবর জানা যায়। নাশতার টেবিলে থাকে স্টেইনলেস স্টিল, মেলামাইন, চিনামাটি ও কাচের তৈরি তৈজসপত্র। বাজারের জন্য ব্যাগ, পড়াশোনার জন্য বইখাতা, কাগজ-কলম। ঘর সাজানোর জন্য ওয়াল ম্যাট, বিভিন্ন ধরনের গৃহসজ্জা সামগ্রী। রান্নার জন্য ইলেকট্রিক হিটার, ওভেন, প্রেসার কুকার, গ্যাসের চুলা ইত্যাদি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। বিনোদনের জন্য সিনেমা, টেলিভিশন, ক্যাসেট ভিসিআর, ভিসিপি, ভিসিডি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য এয়ার কন্ডিশন, খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, চলাচলের জন্য অত্যাধুনিক যানবাহন, যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য টেলিগ্রাম, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট টেলিফোন প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক উপকরণের ওপর মানুষকে নির্ভর করতে হয়। তা ছাড়া বাসায় বা অফিসে সংকেত দেওয়ার জন্য কলিংবেল ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ করা যায়।
(বাকি অংশ আগামীকাল প্রকাশ করা হবে)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা
কবীর