
প্রবন্ধ রচনা
বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ
ভূমিকা: ইংল্যান্ডের সীমানা পেরিয়ে ক্রিকেট বহু আগেই বিশ্বের একটি জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই। দেশের সর্বত্রই ক্রিকেট এখন জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থানে জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট: উপমহাদেশে ক্রিকেটের আগমন হয় ইংরেজদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনামলে। তখন ক্রিকেট ছিল মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক। ১৯৮৭ সালের পর থেকে ঢাকাতে ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে নতুনভাবে ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয়। তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড’ (বিসিসিবি), যা বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোড’ (বিসিবি) নামে পরিচিত।
বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ: বাংলাদেশ ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থার সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ দল প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে। এরপর ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয় এবং ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে জয়লাভ করে। জয়ের আনন্দ পুরো বাংলাদেশ ছুঁয়ে যায়। কারণ, এই জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। বাংলাদেশ দল ১৯৯৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয় লাভ করে। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা দক্ষতা অর্জন করতে থাকে। ২০০৫ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে জিম্বাবুয়েকে ৩-২ ম্যাচে হারিয়ে সিরিজ জয় লাভ করে। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ ম্যাচে হারিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে হোয়াইটওয়াশ করে। ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে। এই অভূতপূর্ব বিজয়ে বিশ্ব নতুন একটি ক্রিকেট পরাশক্তির আবির্ভাব লক্ষ করে। বাংলাদেশে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় বিশ্বের প্রতিটি ক্রিকেট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে জয়লাভ করেছে।
আরো পড়ুন : মানবকল্যাণে বিজ্ঞান/বিজ্ঞানের অবদান বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা, ২য় পর্ব
আইসিসি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ: ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ছয়টি আসরে অংশ নেয়। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নেয় দলটি। প্রথম বিশ্বকাপেই স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে বাংলাদেশ দল। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে সেরা আট-এ এবং ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে আশানুরূপ ফল না পেলেও এই খেলায় বড় বড় দলকে হারিয়ে বাংলাদেশ দল নিজেদের সামর্থ্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়।
টেস্ট খেলার মর্যাদা অর্জন: বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট খেলুড়ে দলের মর্যাদা লাভ করে ২০০০ সালে। ওই বছর ১৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় বাংলাদেশ দলের। অভিষেক টেস্টেই আমিনুল ইসলাম বুলবুল ১৪৫ রান করেন, আর নাইমুর রহমান দুর্জয় পান ৬ উইকেট। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং বিপর্যয়ের কারণে হেরে যায় বাংলাদেশ। পরের বছর অর্থাৎ ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সেঞ্চুরি করে মোহাম্মদ আশরাফুল। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট জয় পায়।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশ: ২০০৫ সালে ৫০ ওভারের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও পাঁচ দিনের টেস্ট-এর সঙ্গে যুক্ত হয় ২০ ওভারের খেলা টি-টোয়েন্টি। এতে একটি দল সর্বোচ্চ ২০ ওভার ব্যাট করতে পারে। বাংলাদেশ ২০০৬ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে আসছে।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট: ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই ঢাকা ও চট্টগ্রামে ক্রিকেট লিগ শুরু হয়। ১৯৭৪-৭৫ সালে জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালু হয়। এ সময় থেকে জেলা পর্যায়েও ক্রিকেট লিগ চলতে থাকে। ১৯৯৯ সালে দেশে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা চালু হয়। তবে ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) যাত্রা শুরু করে, যা বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে একটি চমৎকার সংযোজন। ঘরোয়া ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা নতুন খেলোয়াড় তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আয়োজক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ: একাধিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে সুনাম অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ টেস্ট খেলায় যোগ্যতা অর্জনের আগেই আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপ ১৯৯৮ সালে আয়োজনের দায়িত্ব পায়। ২০১১ সালে বিশ্বকাপের দশম আসরের অন্যতম আয়োজকের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের ভার পড়ে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশের জনগণ ও সংশ্লিষ্টদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা ক্রিকেট বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম, চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়াম ও জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম, বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম, খুলনার শেষ আবু নাসের স্টেডিয়াম, সিলেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেট অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আরও কিছু স্টেডিয়াম রয়েছে।
বাংলাদেশে ক্রিকেটের প্রভাব: পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ক্রিকেট খেলা নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা বিরাজ করে। ক্রিকেট এ দেশের মানুষের দেশপ্রেমকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটের কারণে বাংলাদেশের নাম পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আবার বাংলাদেশের মানুষও পৃথিবীর নানা প্রান্তের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে পারছে। ক্রিকেট একই সঙ্গে বিজ্ঞাপন, বাণিজ্য ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জন্য ক্রিকেট আরেকটি সুফল বয়ে এনেছে, তা হলো-পর্যটনের বিকাশ। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত খেলোয়াড়, ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সদস্য এবং ভক্তকুল বাংলাদেশে বেড়াতে আসে এবং পর্যটন এলাকাগুলোয় ভ্রমণ করে। এতে একদিকে বিশ্বময় বাংলাদেশের পর্যটন-স্থানের নাম ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবোধের বিকাশেও ক্রিকেট খেলা ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খেলা শুরুর আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজতে শুনলে এ দেশের মানুষের মনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার হয়। তখন নিজের দেশের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা জন্ম নেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যখন বিশ্বখ্যাত কোনো দলকে পরাজিত করে, তখন যে আনন্দ হয়, তা দেশপ্রেমেরই আনন্দ।
উপসংহার: বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট খেলা পছন্দ করে। ক্রিকেটের সঙ্গে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের আবেগ জড়িত। তাই বাংলাদেশের বিজয়ে গোটা দেশ যেমন বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে, আবার তাদের পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে। তবে কোনো পরাজয়েই দেশবাসী খেলোয়াড়দের প্রতি আস্থা হারায় না। তাদের সমর্থন ও উৎসাহ দিয়ে যায়, যাতে পরবর্তী খেলায় খেলোয়াড়রা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে। ক্রিকেটের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের উচিত নতুন খেলোয়াড় তৈরিতে ভূমিকা রাখা, উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া এবং ক্রিকেটবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (বাংলা)
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল, ঢাকা
কবীর