সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাত ৯টায় নতুন এক শহরের হাতছানি। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান গ্রীষ্মের এই সময়েও আকাশে রয়ে গেছে সূর্যের কোমল আলো। আমি ও আমার স্ত্রী সোনিয়া ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি বিমানবন্দর থেকে সুইডেনের স্টকহোমে আরলান্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলাম। নির্জন কিন্তু রঙিন আলোয় ভাসমান এই রাতের শহর যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল।
আমাদের বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতেই চোখে সামনে হাজির প্রিয় শরীফ আহমেদ লস্কর ভাই ও ভাবী। সুইডেনে ৪১ বছর ধরে থাকা এই প্রিয় মানুষদ্বয় নিজেই গাড়ি নিয়ে এসেছেন আমাদের নিতে। গাড়িতে উঠতেই মনে হলো, এটি শুধু কোনো শহরের দিকে যাত্রা নয় - এ যেন অতীত, বর্তমান আর অচেনা ভবিষ্যতের এক অন্তরঙ্গ আবেগের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা।

শান্ত রাস্তা, গাছপালা আর আলো-ছায়ার খেলা আমাদের গ্রহণ করে নিঃশব্দে! শরীফ ভাইয়ের মুখে শুধু সুইডেনের গল্প। সুইডেনের রাজতন্ত্র, নাগরিক সচেতনতা, প্রবাস জীবনের আবেগ আর এই শহরের ইতিহাস। তাদের সান্নিধ্যে পথ যেন হয়ে উঠেছিল এক উষ্ণ কবিতা।
পরের দিন শুক্রবার ঈদের সকাল। আমি প্রথমবার স্টকহোমে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছি। আবহাওয়া মেঘলা, হালকা ঠান্ডা, আর বাতাসে এক নিঃশব্দ আনন্দের গন্ধ। ঈদের নামাজ আদায় করি ব্রেদেং মসজিদে, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঈদের আনন্দে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছিল, শহরের ভেতরে একখণ্ড বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে।

নামাজ শেষে প্রিয়জনদের সালাম, হাসি, কোলাকুলি - সব কিছু যেন হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা ভালোবাসার ভাষা। দিনভর ঘুরে বেড়াই চার প্রবাসী বন্ধুর বাড়ি। সেমাই, পোলাও, রোস্ট আর মেহমানদারিতে ঈদের সেই চেনা ঘ্রাণ যেন হৃদয়ের তৃপ্তি হয়ে ওঠে। প্রবাসে থেকেও এ যেন পরিবার, আত্মীয়তা ও দেশকে নতুন করে পাওয়া।
রাত আসে আনন্দের আরেক রূপ নিয়ে। স্টকহোম বোট ক্লাবে অংশ নিই একটি প্রাণবন্ত ঈদ পার্টিতে।

কাকতালীয়ভাবে ঈদের সেই আনন্দময় দিনটিই ছিল সুইডেনের জাতীয় দিবস (৬ জুন)। এই দিনে ইতিহাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় স্মরণ করা হয় ১৫২৩ সালে গুস্তাভ ভাসার রাজ্যাভিষেক, আর ১৮০৯ সালের সংবিধান প্রণয়ন। সেদিন আমি সৌভাগ্যক্রমে রাজা কার্ল গুস্তাফ ষোড়শ, রানি সিলভিয়া, ক্রাউন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স ড্যানিয়েল, প্রিন্সেস এসতেল্লা, প্রিন্স অসকার, প্রিন্স কার্ল ফিলিপ এবং প্রিন্সেস মেডেলাইনকে ড্রটনিংহোম প্যালেসের এক রাষ্ট্রীয় আয়োজনে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়। বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ, জাতীয় সংগীত, পতাকার ঢেউ, শিশুদের নৃত্যগীত - সব মিলিয়ে এক অপার উৎসবের আবহ।

স্টকহোম শুধু একটি দেশের রাজধানী নয় - এটি ইউরোপের ইতিহাস, নান্দনিকতা ও রাষ্ট্রনৈতিক ভারসাম্যের প্রতীক। ১৪টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই শহরের চারপাশে মেলারেন হ্রদ ও বাল্টিক সাগরের সৌন্দর্য, যা একে দিয়েছে “ভেনিস অব দ্য নর্থ” উপাধি। এখানেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠান - আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী স্টকহোম সিটি হলে।
এর পরের দিন শনিবার সকাল থেকে শুরু হলো আমাদের স্টকহোম শহরে ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। দিনভর এই ভ্রমণে আমার সহযাত্রী ছিলেন সুইডেনে ৩৮ বছর ধরে বসবাসরত, প্রবাসী সমাজে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন মহিউদ্দিন আহমেদ জিন্টু ভাই। তিনি শুধু স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির একজন পরিচিত মুখই নন, বরং একজন উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ, যিনি প্রবাসীদের পাশে থাকেন নিরলসভাবে। তার গাড়িতে চড়ে আমরা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলি - নানা দর্শনীয় স্থান আর ইতিহাসের ছোঁয়া নিতে। তার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় স্টকহোম শহরের প্রতিটি ইট-পাথরের মধ্যেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল এক দীর্ঘ প্রবাস ইতিহাস।

বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সময় দেন আরেক গর্বিত প্রবাসী নাহিদ হাসান। যিনি “শান্তি” নামে আটটি রেস্টুরেন্টের কর্ণধার। তার গাড়িতে চড়ে আমি যেন শুধু এক শহর দেখিনি, দেখেছি একজন উদ্যোক্তার দৃঢ় পথচলা। তার হাসিমুখ, আত্মবিশ্বাস, আর শহরের প্রতিটি অলিগলি চিনে নেওয়ার গল্প আমাকে মুগ্ধ করেছে।
রবিবার দুপুরে আমরা দাওয়াতে যাই স্বপন ভাইয়ের বাসায়। যার আতিথেয়তায় ছিল দেশি আবেগের নিখুঁত মিলন। ঘরোয়া পরিবেশ, হাসি আর পরিচিত খাবারের ঘ্রাণ - মনে হচ্ছিল, প্রবাসে এসেও যেন এক টুকরো বাংলাদেশকে ছুঁয়ে ফেললাম।

রাতের পর্বটি ছিল আরেক সম্মানিত প্রবাসী নেতার সান্নিধ্যে। নাজমুল আবেদীন মোহন ভাই, যিনি স্থানীয় কমিউনিটির অগ্রজ, একজন প্রতিষ্ঠিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক। তার আমন্ত্রণে আমরা উপস্থিত হই তার রেস্টুরেন্টে। কথা হয় বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রবাসের দায়িত্ববোধ ও আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে। এইসব মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমরা কেবল খাবার খেতে নয় - ভবিষ্যতের কিছু স্বপ্ন একসঙ্গে ভাগ করে নিতে এসেছি।
এই দুই দিন আমরা ঘুরে দেখেছি স্টকহোমের প্রাণ-খ্যাত কিছু স্থান। প্রথমেই পা রাখি গামলা স্তান-বে (Gamla Stan)। এটি স্টকহোমের প্রাচীনতম শহরকেন্দ্রে। এখানে রাজপ্রাসাদ, আঁকাবাঁকা পাথরের গলি আর রাজকীয় প্রহরীদের কুচকাওয়াজ যেন আপনাকে শতাব্দী পেছনে নিয়ে যায়। প্রতিটি দেওয়ালে, প্রতিটি অলিতে যেন লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাসের গল্প।

এরপর যাই ভাসা মিউজিয়ামে (Vasa Museum)। ১৬২৮ সালে সমুদ্রযাত্রার প্রথম দিনেই ডুবে যাওয়া বিশাল যুদ্ধজাহাজ “ভাসা” এখানেই সংরক্ষিত। আজও সেটি দাঁড়িয়ে আছে - একজন ব্যর্থতা থেকে শেখা ইতিহাসের নিদর্শন হয়ে।
স্ক্যানসেন ওপেন-এয়ার মিউজিয়ামে দেখি সুইডেনের পুরনো গ্রামীণ জীবন, কুটির শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষিকাজ আর সংস্কৃতির বাস্তব নিদর্শন। আর ড্রটনিংহোম প্যালেসে এসে আমরা পরিচিত হই সুইডিশ রাজপরিবারের বর্তমান বাসভবনের সঙ্গে - যা ইউরোপের আধুনিক রাজতন্ত্রের এক প্রতীক।

৯ জুন সকাল সাড়ে সাতটায় ছিল আমাদের ফিরতি ফ্লাইট স্টকহোম থেকে হেলসিংকির উদ্দেশ্যে। শরীফ আহমেদ লস্কর ভাই সেদিনের মতো নিজের গাড়িতে করেই আমাদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে আন্তরিক বিদায় জানান। বিদায়ের সময় গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেই স্টকহোমের দিকে, যে শহর আমাদের চার দিনের আশ্রয় ছিল - তবে আজ মনে হলো, সে যেন চিরদিনের আত্মীয়।
শহরের সৌন্দর্য যেমন মন ছুঁয়েছে, তার মানুষের আন্তরিকতা, ঈদের অনুভব, ইতিহাসের ভার আর নদীর ধারে সূর্যাস্ত - সব কিছু মিলে তৈরি করেছে এক অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা।
স্টকহোম আমার কাছে আর শুধু একটি শহর নয় - এটি একটা গল্প, একটা অনুভব, একটা স্মৃতির নাম।
অমিয়/