চাকরি ছেড়ে দেওয়া যেমন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, তেমনি চাকরি বদল করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা আর মানিয়ে চলা যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তখন একজন কর্মী চাকরি বদল করতে চায়। আবার অন্য প্রতিষ্ঠানে মোটা বেতনে চাকরির অফারসহ নানা কারণে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেন বা চাকরি ছাড়ার চিন্তা করেন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধা হলো, এক চাকরি দিয়েই বাকি জীবন নিশ্চিন্তে পার করা যায়। যেমন প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলি বা পদোন্নতি হবে, কাজের ধরন বা ক্ষেত্র বদলাবে, নতুনত্ব আসবে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে কাজের পরিধি এবং সুযোগ-সুবিধাও বিস্তৃত হতে থাকবে। আপনার দায়িত্ব শুধু কাজ করে যাওয়া। বিনিময়ে পাবেন সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা।
তবে করপোরেট সেক্টরের চাকরির ধরন একবারেই আলাদা। আপনি কোন পথে হাঁটবেন, ক্যারিয়ারে কীভাবে সামনের দিকে এগোবেন, বেতন বাড়বে কি না কিংবা প্রতিষ্ঠান আপনাকে কতটা মূল্যায়ন করবে-সবকিছুই নির্ভর করবে নিজের ওপর। আর প্রতিটি পদে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ তো আছেই। প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভালো না হলে আর্থিক টানাপোড়েন আসাও অস্বাভাবিক নয়। এ সবকিছু পাড়ি দিয়েই করপোরেট সেক্টরের সিঁড়ি ভাঙতে হয়। এই যাত্রার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো চাকরি বদল।
চাকরি বদলের সঠিক সময় কোনটি, চাকরি বদল করতে হলে কী কী কৌশল অবলম্বন করতে হবে- এই বিষয়গুলো জানা থাকলে ক্যারিয়ারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সহজ হবে।
চাকরি বদলের সঠিক সময়
ভ্যারিয়েশন না থাকলে একই ধরনের কাজ দীর্ঘদিন ধরে করতে থাকলে শেখার সুযোগ কমে যায়। একঘেয়েমি তো আছেই। তা ছাড়া পদোন্নতিও যদি না হয় তাহলে বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠান আপনাকে শুধু খাটিয়ে নিচ্ছে, মূল্যায়ন করার ব্যাপারে খুব একটা সচেষ্ট নয়। আপনি আপনার বসের সঙ্গে দু-একবার এ ব্যাপারে কথা বলতে পারেন, যদি ইতিবাচক সাড়া না পান সেক্ষেত্রে বিকল্প চিন্তা শুরু করুন। তা ছাড়া বর্তমান চাকরিতে আশানুরূপ বেতন না পেলেও নতুন সুযোগ খোঁজা উচিত।
অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা কর্মীদের কাছ থেকে সবটুকু আদায় করে নেয়, কিন্তু বেতন বাড়ানোর কথা উঠলেই গড়িমসি করে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বেশি দিন চাকরি করলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
সরকারি চাকরিতে ‘বস’ বদল হয়। যার কারণে কাজের চাপ ও মানসিক চাপ অসহনীয় হলেও একটা সময়ে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। কিন্তু করপোরেট সেক্টরে তেমনটা ঘটে না। ধরুন আপনি একটা কোম্পানির ম্যানেজার। প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজেই সিইও, আপনার বস। তিনি আপনাকে অত্যধিক চাপে রেখেছেন। সপ্তাহে সাত দিন যখন-তখন নানা দায়িত্ব চাপাচ্ছেন, পান থেকে চুন খসলেই বকাঝকা করছেন। আপনি নিজের জন্য কোনো সময় বের করতে পারছেন না। একপর্যায়ে অফিস আপনার জন্য ‘টক্সিক’ হয়ে উঠবে, মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে চাকরি বদলানোর কথা মাথায় আসাই স্বাভাবিক। কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করা যাবে না।
কর্মপরিবেশ, কাজের ধরন, বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ তুলনামূলক ভালো চাকরির অফার পেলে অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত। সেখানে হয়তো আপনি নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরতে পারবেন, যা আপনার ক্যারিয়ারে ‘গ্রোথ’ হিসেবে যুক্ত হবে। যদি সেখানে আপনার দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা হয় এবং আপনিও দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ পান, তবে কেন নয়? তবে চাকরির বাজারে যখন তখন ভালো চাকরি পাওয়া যায় না। যে কয়টা নতুন সুযোগ তৈরি হয়, সেখানেও ‘ডায়নামিক’ ক্যান্ডিডেটরা জায়গা দখল করে। ফলে সব সময় নিজেকে ‘ডায়নামিক’ হিসেবে তৈরির চেষ্টা করতে হবে।
চাকরির বাজারে কিছু কৌশল
বর্তমান চাকরির অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ঝালিয়ে নিন: বর্তমান চাকরিতে কী কী শিখেছেন এবং কীভাবে নতুন জায়গায় তা কাজে লাগাতে পারবেন, তা বুঝতে হবে।
নেটওয়ার্কিং করুন: আপনি যে সেক্টরে চাকরি করছেন সেখানকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, লিংকডইন ব্যবহার করুন এবং বিভিন্ন করপোরেট ইভেন্টে অংশ নিন।
সঠিক সময় নির্বাচন করুন: চাকরির বাজারের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিন। বছরের শুরুর দিকে নতুন নিয়োগ বেশি হয়।
সঠিক প্রতিষ্ঠান বাছাই করুন: নতুন প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিবেশ, বেতন কাঠামো ও আপনার নিজের উন্নতির সুযোগ-যাচাই করুন।
গোপনীয়তা বজায় রাখুন: চাকরি খোঁজা ও ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কোনো কিছু চূড়ান্ত না হলে বর্তমান প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের কাছে না বলাই ভালো।
নিশ্চিত সুযোগ পেলেই তবে সিদ্ধান্ত নিন: নিশ্চিত অফার হাতে না থাকলে চাকরি ছেড়ে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাই নতুন চাকরির নিশ্চয়তা পেলে তারপর চাকরি ছাড়ার কথা চিন্তা করুন।
স্মার্ট সিভি ও কাভার লেটার তৈরি করুন: সিভি মানে একখণ্ড কাগজে কতগুলো নাম-ঠিকানা নয়। এটি আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রতিফলন। তাই স্মার্ট সিভি ও কাভার লেটার তৈরি করুন।
ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি নিন: ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে রিসার্চ করুন, সাধারণ প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত রাখুন এবং আত্মবিশ্বাসী থাকুন। যাতে করে নতুন চাকরির ইন্টারভিউয়ে আপনাকে কেউ আটকাতে না পারে।
চাকরি ছাড়ার সময় করণীয়
চাকরি ছাড়লে আপনার ক্যারিয়ারে কী প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়ে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করতে হবে। হঠাৎ চাকরি ছাড়ায় যাতে অন্য কোনো বিষয়ে প্রভাব না পড়ে, সেদিকে নজর দেওয়া খুবই প্রয়োজন। চাকরি ছাড়ার কারণে আপনি যেন আর্থিক সংকটে না পড়েন এদিকেও বিবেচনা করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করুন: বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই চাকরি ছাড়ার এক মাস আগে এইচআরকে জানাতে হয়। সে অনুযায়ী নোটিশ দিন। সহকর্মীদের কাছে ইতিবাচক ছাপ রেখে যান: পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখুন, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। অন্য কোথাও একসঙ্গে কাজের সুযোগ হতে পারে।
প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, রেফারেন্স বা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করুন: এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট, স্যালারি স্টেটমেন্ট ও সুপারভাইজারের রেফারেন্স লেটার সংগ্রহ করুন। এগুলো আপনার ক্যারিয়ারের একেকটা মাইলফলক।
তারেক